দেশের দুই রাজ্যের মধ্যে সেদিন গৃহযুদ্ধ ঘটিয়েছিল ফুলনের এই বাস্তব বুদ্ধি
আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ১২)
সৌগত রায় বর্মন
১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৬। এই দীর্ঘ সময়টা ফুলনের কি ভাবে কেটেছে তা আমরা জানি। জেলে। কিন্তু তার আগে? মানে আত্মসমর্পণ করার আগে তাকে কুত্তার মত বেহড়ে বেহড়ে খুঁজে বেরিয়েছে পুলিশ। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। কারণ ইউপি পুলিশের ওপর ঠাকুরদের বিরাট প্রভাব ছিল এবং বেহমাই কাণ্ডে যারা খুন হয়েছিল ফুলনের হাতে, তাদের প্রায় সবাই হয় গুর্জর না হয় ঠাকুর। তাই জ্যান্ত ফুলনকেই ওদের চাই। তারা ফুলনকে পুড়িয়েই হয় তো মারত, যদি খুঁজে পেত ! কিন্তু ফুলনের সৌভাগ্য যে তাকে বেহড়ে চিরুণি তল্লাশি করেও পাওয়া যায়নি ।
অজ্ঞাতবাস পর্বে ফুলনের দল বলতে তেমন কিছু ছিল না। বেহমাই পরবর্তী সময়ে যে ডাকাতদের কোনও দলকেই ছেড়ে দেওয়া হবে না, তা জানা কথাই ছিল।
সে সময় ডাকাত দলের অনেকেই পুলিশের অতি সক্রীয়তায় ভয় পেয়ে গেছিল। ফুলনকে সাহায্য করলে পাছে পুলিশ তাদের পিছনে পড়ে যায়?
তাই বেহড় পর্বে ফুলন প্রায় সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় দু’বছর যে কি করে টিকে থাকল তা বিস্ময়কর। একেই বলে সার্ভাইবাল।
ব্যাতিক্রম একমাত্র বাবা ঘনশ্যাম। সেই ফুলনকে শিখিয়ে ছিল পুলিশকে এড়িয়ে কি করে পালিয়ে থাকা যায়।
ফুলন সম্পর্কে চম্বলের সাধারণ মানুষের খুব একটা উচ্চ ধারণা ছিল না। একে তো সে নীচু জাত। তার ওপর পৌরুষকে সে ভয়ঙ্কর আঘাত করেছিল। তা মানতে পারেনি ওখানকার বীর পুজারী মানুষেরা ।
কারণ পুলিশের ভয়ে সে চম্বলের রবিন হুড কার্ড খেলার সুজোগই পায়নি। সাধারণ মানুষের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করতে পারেনি।
আগেই বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের লোকজন বীর ভক্ত। ফুলন তাদের কাছে বীরের সম্মান পায়নি। আসলে পুলিশের সঙ্গে কে কটা এনকাউন্টার করল তার ওপর নির্ভর করে এই ভক্তি। সেখানে ফুলন মাত্র দুটো কি একটা গুলির লড়াই করতে পেরেছে। তাও পালানোর উপায় স্বরূপ। সুতরাং বীর সে হতে পারেনি। কেন নারী বলে?
এতো গেল মাটির নীচের নাটক। ওপরে কিন্তু আরেক নাটক তখন অভিনীত হচ্ছে।
বেহমাই হত্যা কাণ্ডের পর ঠাকুরদের প্রবল চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভিপি সিং। সুতরাং পাশের রাজ্য মধ্যপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের কোর্টে তখন বল। যেভাবেই হোক ফুলনকে মধ্যপ্রদেশেই আত্মপমর্পণ করাতে উদ্যোগী হয়ে উঠল এই পুলিশ।
ক্রমশ মারা যেতে লাগল ফুলনের দলের ডাকাতরা। মোটে চার থেকে পাঁচ জনকে নিয়ে তখন দল চালাচ্ছে ফুলন। বাবা ঘনশ্যামের দয়ায় বেহড়ে কোনও রকমে টিকে থাকতে লাগল সে।
কিন্তু একেই বলে জেদ। দু’বছর ধরে তল্লাশি চালিয়েও ফুলনকে ধরতে পারল না পুলিশ।
এল ১৯৮১ সাল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবার নড়ে চড়ে বসলেন। নির্দেশ দিলেন যেভাবেই হোক ফুলনকে আত্মসমর্পণ করাতেই হবে।
মধ্যপ্রদেশের এক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী ফুলনের গোপন ডেড়ায় এলেন। দেখা করলেন তার সঙ্গে। আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিলেন ফুলনকে।
ফুলন সম্ভবত এই সুজোগটাই খুঁজছিল । ভাঙা দল নিয়ে পুলিশের হাত থেকে সে বেশীদিন টিকে থাকতে পারবে না। আর পুলিশ যদি তাকে গ্রেফতার করতে পারে তবে তার মৃত্যু অনিবার্য ।
ফুলন কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে আত্মসমর্পণে রাজি হয়ে গেল, তা ছাড়া তার কোনও উপায় ছিলনা ।
তার প্রথম শর্ত ছিল মৃত্যুদন্ড দেওয়া যাবে না। শুধু তাকেই নয় তার দল বলকেও। এক খন্ড জমি দিতে হবে খাওয়া পরার জন্য। হাতে হাতকড়া পরানো যাবে না।
এগুলি তো সাধারণ শর্ত, সব ডাকাতরাই দেয়।
ফুলনের বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় তার শেষ শর্তে। কি সেটা?
ফুলনের পরিবারকে উত্তরপ্রদেশ থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিতে হবে মধ্যপ্রদেশের পুলিশের আস্তানায়।
সে সময় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ফুলনের পরিবারের ছোট ভাই, বোন, বাবা ও মাকে তাদের গ্রাম থেকে তুলে এনে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল। পুলিশের আস্তানায়, নিশ্ছিদ্র প্রহরায়।
তাহলে উপায়? মধ্যপ্রদেশের পুলিশের কর্তারা পড়ল মহা ফ্যাসাদে । বহু রাত জাগা আলোচনার পর দেখা গেল একটাই রাস্তা আছে। কিডন্যাপ।
সত্যিই আর কোনও পথ ছিলনা।
সুতরাং শুরু হল প্রস্তুতি। একই দেশের দুটো রাজ্যের মধ্যে শুরু হতে যাচ্ছে গৃহযুদ্ধ। কার জন্য? একজন নারী ডাকাতের জন্য।
তাই হল, গভীর রাতে মধ্যপ্রদেশের একদল পুলিশ কমান্ডো হানা দিল উত্তরপ্রদেশের পুলিশ আস্তানায়, যেখানে আটকে রাখা হয়েছে ফুলনের পরিবারকে।
রীতিমতো গুলির লড়াই লড়ে ইউপি পুলিশের আওতা থেকে উদ্ধার করা হল ফুলনের পরিবারকে।
সে সময় এই নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের তরফ থেকে পুরো ব্যাপারটাই অস্বীকার করা হয়। বলা হয় ফুলনের পরিবার পালিয়ে মধ্যপ্রদেশের পুলিশের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। ইউপি পুলিশ লজ্জায় আর কোনও প্রতিবাদ করেনি।
দেশে এতবড় একটা গৃহযযুদ্ধের সূচনা করেছিল স্বয়ং সেই ফুলন।
সুতরাং পথের কাঁটা দূর হল।
আত্মসমর্পণের ঢাকে কাঠি পড়ল।
১৯৮৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলন এক অনারম্বড় অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করে ভিন্দ শহরে, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং এর কাছে। গান্ধী মূর্তীর পাদদেশে।
তার স্যারেন্ডারের খবর পেয়েই পরিবর্তন পত্রিকার তরফ থেকে দিব্যজ্যোতি বসু আর আমি মে মাসের তীব্র দাবদাহ গায়ে মেখে চম্বলে গেছিলাম ফুলন সহ বাকী ডাকাতদের সঙ্গে একটু আলাপ করতে। সফল হয়েছিলাম কি না বলতে পারব না।
ফুলনের বাকী গল্প কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
পরের পর্বে বাকিটা বলা যাবে।
আগামী খন্ডে পড়ুন ফুলনের শেষ পর্ব