September 29, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

দীর্ঘ বেহড়ের জীবন শেষ বয়েসেও তাড়া করে বেড়াত নবাব সিংকে

[kodex_post_like_buttons]

সামান্য কুয়োর জল নিয়ে এত খুন খারাপির কি সত্যিই কোনো দরকার ছিল? প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করতে হল, ঠাকুরের জ্বাত্যাভিমানে যদি লাগে! নবাব সিং খানিকটা উদাস হয়ে বলে উঠল, পানি কিসিকা অপনা সামান নেহি হ্যায়! ভগবান কি দান। আমার ঘরের মেয়েদের যারা ইজ্জত দিতে পারবে না, তাদের আবার গুলিতে ফোঁপড়া করে দেব। 

সৌগত রায় বর্মন  

মান সিং এর হাভেলিতে নবাব সিং এর সঙ্গে আড্ডা। সম্ভবত আমাদের আগে আর কেউ এই সুযোগ পায়নি। সেই তল্ফিরাম থেকে শুরু। তারপর থেকে ১৬৮টি ডাকাতির বর্ণনা দেওয়া বড়েবাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার বয়েস তখন ১০৭ বছর । কথা যখন শেয হল তখন আর রছেড়ে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। মানে শেয বাস চলে গেছে দুপুর নাগাত। অত:কিম? তা হলে কি রাত্রিবাস এই হাভেলিতেই? বাগী নবাব সিং আনাদের হোস্ট? এমনও হতে পারে?

মোহরচাচা থেকে গেল আমাদের জামিন হিসেবে।
এখানে সূর্য ডুবলেই রাত্রি। সন্ধের কোনো প্রশ্নই নেই। বিশেষ করে শীতে। 
কথায় কথায় তল্ফিরামের কথা উঠল। যাদের বংশ প্রায় নির্বংশ করে দিয়েছিল নবাব সিং একার হাতে। সামান্য কুয়োর জল নিয়ে এত খুন খারাপির কি সত্যিই কোনো দরকার ছিল? প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করতে হল, ঠাকুরের জ্বাত্যাভিমানে যদি লাগে! নবাব সিং খানিকটা উদাস হয়ে বলে উঠল, পানি কিসিকা অপনা সামান নেহি হ্যায়! ভগবান কি দান। আমার ঘরের মেয়েদের যারা ইজ্জত দিতে পারবে না, তাদের আবার গুলিতে ফোঁপড়া করে দেব।
ইতিহাস মতে জয় প্রকাশ নারায়ণ দুই পরিবারকে এক করে দিয়েছিলেন। অবসান হয় দীর্ঘমেয়াদী শত্রুতার।
রাতে আমাদের শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল হাভেলির বারান্দায়। ঘরে মহিলারা আছেন, তাই। প্রবল শীতেও কিন্তু কোনো কষ্ট হয়নি। দুটো কম্বল নিচে আর দুটো গায়ে। আসলে প্রবল একটা উত্তেজনা রক্তে কাজ করছিল। মান সিং এর বাড়িতে রাত কাটাচ্ছি, এও কি সম্ভব?
ঘুম আসছিল না। নবগ্রাম হয়ে হরিদেবপুর, চেতলা হয়ে চম্বলে, তাও মান সিং নামক এক কিম্বদন্তী ডাকু ওরফে বাগীর বাড়িতে রাত্রিবাস? সত্য নাকি স্বপ্ন? এই সব ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রা মতো এসে গেছিল। হঠাতই মাঝরাতে তন্দ্রা কেটে গেল প্রবল একটা চিৎকার শুনে। কউন হ্যায়? কউন হ্যায় উধর? চিৎকার করছে স্বয়ং নবাব সিং। ছুটে এল রামদিন। এপাশ ওপাশ টর্চ মেরে দেখে বলল, কোই নেহি হ্যায় বড়েবাবা। আপ শো যাইয়ে। পরে জানলাম দীর্ঘ বেহড়ের জীবন আজও তাড়া করে বেড়ায় বড়েবাবাকে। প্রায় কোনো রাতেই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারে না।
তারপর আবার অখন্ড নীরবতা। মাঝে মাঝেই শুনতে পেলাম তার গলায় রামলীলা ভজন। কী অসীম বইপরিত্ব! আজও কানে লেগে আছে সেই বেসুরের সুর। কেন ওরা ডাকু? কেন খুনে? কেন রক্তে রাঙানো দুটো হাত? কেন নয় সংগঠিত প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিবাদী?
সকাল হতেই প্রাকৃতিক কাজে মাঠে। সারা চম্বল ঘুরে একবারও মনে হয়নি, জায়গাটা বিপদসংকুল, বিপজ্জনক বা এখানকার সবাই “দুর্ধর্ষ দুশমন “.।  কিন্তু সকালে মাঠে গেলেই ময়ূরের বাহিনী আমাদের ঘিরে ধরত । সে তাদের কী আস্ফালন। এখানকার ময়ূর ময়ুরীরাও বোধহয় বাগী ছাড়া কাউকে পাত্তা দেয় ন। 
নকল ডাক্তার হাজরার আংগুল কামড়ে দিয়েছিল ময়ূর। নিরস্ত্র অবস্থায় যদি আমাদের অন্য কিছু…?
2
দুপুরে আমরা খেরা রাঠোর সংলগ্ন গ্রাম ও বেহাড়গুলি ঘুরে বেড়ালাম, উটের পিঠে। বেহড়ের রূপ সর্বত্র একই রকম। তল্ফিরামের কোঠিতে গিয়ে মিঠাই খেলাম। এখন আর কোনো শত্রুতা নেই। শান্তি কল্যান হয়ে আছে।
খেরা রাঠোর গ্রামে এমন একটা বিস্ময় প্রত্যক্ষ করলাম, যা অবিশ্বাস্য। একটা মন্দির। পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন। বিগ্রহ দেখে মনে হল, বিষ্ণু। কিন্তু কোনো পুরহিত নেই। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তাদের জিজ্ঞেশ করাতে সে বলল,  ঠাকুর মান সিং এর মন্দির এটা। গ্রামের সবাই এখানেই পুজো দিতে আসে। বড়েবাবা তার সময়ে এখানে পুজো দিয়ে তবে অভিযানে যেত।
৩ 
ফেরার পথটা আর উটের পিঠে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমাদের ছিল না। বাসে যাওয়াই ঠিক হল।
ঘন্টা তিনেক লেগে গেল রছেড় পৌঁছতে ।
কিন্তু এ কী এত পুলিশ কেন? আমাদের ধরবে বলে! বিস্ময়ে মৃদুলদার দিকে তাকালাম। সেও হতচকিত।
আমাদের দেখেই এক হোমড়া চওড়া পুলিশ অফিসার হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। মৃদুলদার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ক্যায়সে হ্যায় আপ? মানে?
আসলে ঘটনাটা খুবই সামান্য। আমরা চম্বল আসার আগে “পরিবর্তন” পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অশোক চৌধুরী একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন আগ্রার পুলিশ সুপারকে। তিনি আশোক চৌধুরীর বন্ধু স্থানিও ছিলেন। আমরা চম্বলে আসার পর কথা ছিল, আমরা প্রতি দুদিন পর পর চিঠি লিখে জানাব, কেমন আছি, কোথায় আছি। ঘটনার ঘনঘটায় আমরা না দেখা করেছি সেই পুলিশ সুপারের সঙ্গে, না লিখেছি চিঠি। ফলে দুশ্চিন্তায় সম্পাদক এবং প্রধান সম্পাদক সেই পুলিশ সুপারকে আমাদের ব্যাপারে অবহিত করেন। আমরা যে মুরেনার রছেড় গ্রামে থাকব, তা অশোকবাবু জানতেন। পুলিশ কে সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই পুলিশ এসেছে আমাদের খোঁজ করতে।
এবার উপায়? পুলিশ নিয়ে তো আর প্র‍্যকটিসিং বাগীদের কাছে যাওয়া যায় না। 
আমরা হায় হায় করে ঊঠলাম। আমাদের বাড়াভাতে ছাই পড়ল। তখন মালখান সিং বেহড় কাঁপাচ্ছে। তার সঙ্গে একটা গোপন সাক্ষাৎকারের ব্যাবস্থা করছিল রতন সিং। আর মনে হয় হল না।
পুলিশ দেখে গ্রামের সবার মুখভার। হয়তো আমাদের মুখবীর ভাবছে। একমাত্র রতন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। সে সুযোগ পেয়ে বলল, মালখান সিং এর সঙ্গে আর দেখা হবার চান্স নেই। পুলিশ আপনাদের পিছু ছাড়বে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবার ফিরে যান। নইলে বিপদ।
সুতরাং ফিরে আসাই মনস্থ করলাম। অশোকবাবুর পিতৃসুলভ স্নেহের জন্য প্র‍্যকটিসিং এক ডাকুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একটা সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।
আমাফের প্রথম চম্বল অভিযান সেখানেই শেয। ফিরে এলাম কলকাতায়।
পুনঃ চম্বলের এই অভিযান স্বচিত্র ছাপা হয়েছিল ৮০ সালের পরিবর্তন পত্রিকায়। তখনও ফুলনদেবী ব্যান্ডিট কুইন হয়ে ওঠেনি। ফুলন ও মালখানের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল ৮২ সালে। সে কাহিনি পরে সুযোগ পেলে বলা যাবে।
(সমাপ্ত)

Related Posts

Leave a Reply