সূর্য-চাঁদ ঢাকা দেওয়া এক দিন আর হবে না! কি বলছে বিজ্ঞান
কলকাতা টাইমস :
এমন এক দিন আসবে, যখন পৃথিবী থেকে আর দেখা যাবে না সূর্যগ্রহণ। চাঁদ দিয়ে সূর্যের মুখ ঢাকা-চাপা দেওয়া আর সম্ভব হবে না। মুখ লুকোতে পারবে না চাঁদও। তাই সে দিন চন্দ্রগ্রহণও আর দেখা যাবে না আমাদের এই গ্রহ থেকে।
সে দিন কোন গ্রহণকেই আর ‘গ্রহণ’ করা সম্ভব হবে না পৃথিবীর! কারণ চাঁদ আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূরে। উত্তরোত্তর। বছরে হাতের নখ যতটা বাড়ে, ফি বছর আমাদের ছেড়ে ততটাই দূরে চলে যাচ্ছে চাঁদ। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সূর্যের আরও কাছাকাছি। চাঁদ আছে বলেই তো যাবতীয় গ্রহণের আলো-আঁধারি। তাই সুর্য আর চন্দ্রগ্রহণ, যা নিয়ে আমাদের এত মাতামাতি, ৬৫ কোটি বছর পর পৃথিবী থেকে আর সে সব কিছুই দেখা যাবে না।
তার ফলে, পৃথিবী যে লাট্টুর মতো নিজের চার দিকে ঘুরছে, তার ওপর চাঁদের ‘খবরদারি’ কমে যাবে। কমে যাবে পৃথিবীর লাট্টুর গতি। আমাদের পার্থিব দিন আরও বড় হয়ে যাবে, ২৪ ঘণ্টার চেয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা বেশি। চাঁদ অনেক অনেক দূরে চলে যাওয়ার ফলে আজ থেকে ৬৫ কোটি বছর পর পার্থিব দিন হবে ২৭ ঘণ্টা! বছরে দিনের সংখ্যাও আর ৩৬৫ থাকবে না।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন, সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগে জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর। আর তার একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ গড়ে উঠেছিল আরও ৫০ কোটি বছর পর। আজ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে। সেই সময় চাঁদ অনেক বেশি কাছাকাছি ছিল পৃথিবীর ‘হৃদয়’-এর। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল তখন মাত্র সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার বা ১৪ হাজার মাইল।
একেবারে আমাদের নাগালের মধ্যেই! পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর দূরত্ব ১২ হাজার ৪৩০ মাইল। আর আজ, সরতে সরতে সেই চাঁদ চলে গিয়েছে পৃথিবী থেকে ৪ লক্ষ ২ হাজার ৩৩৬ কিলোমিটার বা আড়াই লক্ষ মাইল দূরে! মানে, প্রায় ১৮ গুণ বেশি দূরত্বে।
অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লুনার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি ল্যাবরেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বিষ্ণু রেড্ডি বলছেন, বছরে আমাদের হাতের নখ যতটা বাড়ে, প্রত্যেক বছরে চাঁদ ঠিক ততটা দূরত্বই সরে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। সেই দূরত্বটা বছরে ৩.৭৮ সেন্টিমিটার বা ১.৪৮ ইঞ্চি। তার ফলে, জন্মের পর থেকেই পৃথিবী যতটা জোরে লাট্টুর মতো ঘুরছে নিজের চার দিকে (পৃথিবীর আহ্নিক গতি), তা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে।
সহজে মালুম না হলেও, যার জেরে নিজের চার দিকে পাক মারতে প্রতি বছর ১৪ মাইক্রো সেকেন্ড করে সময় বেশি লাগছে পৃথিবীর। সে জন্যই পৃথিবীর ঘড়িকে আপডেটেড রাখতে ১৮ মাস অন্তর জুড়তে হয় ‘লিপ সেকেন্ড’। অধ্যাপক রেড্ডির বক্তব্য, ৬৫ কোটি বছর পর চাঁদ পৃথিবীর থেকে যে দূরত্বে পৌঁছে যাবে, সেখান থেকে তার পক্ষে আর সূর্যের মুখ ঢাকা সম্ভব হবে না। চাঁদ যে সূর্যের মুখ ঢাকছে, অন্তত পৃথিবী থেকে তা আর দেখা যাবে না। পুরোপুরি বা আংশিক, কোনওটাই নয়।
জন্মের পর থেকে এখনও পর্যন্ত চাঁদ আমাদের সঙ্গ ছেড়ে অনেকটাই দূরে চলে যাওয়ার ফলে, ইতিমধ্যেই আমাদের গ্রহে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। চাঁদ যত দূরে চলে যাবে, ততই কমতে থাকবে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সংখ্যা। সেই সময় খণ্ডগ্রাস আর বলয় গ্রাস সূর্যগ্রহণ বাড়বে। আর থাকবে সংকর গ্রাস। এখন ১৮ মাস অন্তর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও হয় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, মোট চার রকমের সূর্যগ্রহণ দেখা যায় পৃথিবীতে। পূর্ণগ্রাস, খণ্ডগ্রাস, বলয় গ্রাস ও সংকর গ্রাস। এই চার রকমের মধ্যে এখন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয় মাত্র ২৮ শতাংশ। ৩৫ শতাংশ হয় খণ্ডগ্রাস, ৩২ শতাংশ বলয় গ্রাস।
আর মাত্র ৫ শতাংশ হয় সংকর গ্রাস। অথচ, ৪০০ কোটি বছর আগে যখন চাঁদ জন্মাল, তখন পূর্ণগ্রাস হত মোট সূর্যগ্রহণের ৫০ শতাংশেরও কিছু বেশি। কারণ, চাঁদ সেই সময় খুব কাছে ছিল পৃথিবীর। ফলে চাঁদের পক্ষে সূর্যের মুখ পুরোপুরি ঢেকে দেওয়ার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেত। তার ছায়াটা অনেক বেশি এলাকা জুড়ে পড়ত পৃথিবীর ওপর। আর ৩০ কোটি বছর পর পূর্ণগ্রাসের হার কমে হবে ১০ শতাংশ। ৫০ কোটি বছর পর তা হবে মাত্র ২ শতাংশ। আর ৬৫ কোটি বছর পর পৃথিবী থেকে আর কোনও ধরনের গ্রহণই দেখা সম্ভব হবে না।