‘দলে কেউ একজন গদ্দার আছে, যে বাবাকে এই খবর দিয়েছে’
আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ৮)
সৌগত রায়বর্মন: ধোঁয়ার রহস্য তো বোঝা গেল, কিন্তু এই বিরাট ধংস স্তুপ, ভগ্ন প্রাসাদ কোথা থেকে এলো ?
পাশের ভিস্তিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, এখানে এক সময় বুন্দলখন্ডের রাজারা শিকারে আসত। এই প্রসাদ থেকে তারা মৃগয়া করতে জঙ্গলে ঢেরা পিটিয়ে শিকার করত।আমরা যে ধ্বংসাবশেষ দেখছি, এককালে তার নাম ছিল মঞ্জিলগড়। এখন ডাকাত বা জানোয়ারের বাসভূমি।
মঞ্জিলগড়ের ধ্বংসস্থাপত্ব দেখে মুগ্ধ হও য়া ছাড়া আমাদের কোনো গতি ছিল না। মনে হচ্ছিল প্রতিটি অংশের ছবি তুলে রাখি।
কিন্তু আমরা তো আর আর্কিওলজিস্ট নই । সেই সুদুর কলকাতা থেকে এসেছি ডাকাতের খোঁজে । বাবা ঘনশ্যামকে ধরতে পারলে ফুলন সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য জানা যেতে পারে।
রামসুন্দরের মুখ দেখে মনে হল, খুব চিন্তিত। হাতের ডগা থেকে এভাবে ডাকাত দল উড়ে যাবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
বিরস বদনে আমাদের সামনে এসে সে বলল, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। কথা দিয়ে চোখের সামনে দিয়ে ওরা পালিয়ে গেল।
এতক্ষনে আমাদেরও সম্বিত ফিরে এলো, তাই তো, একটা পুরো ডকাত দল আমরা আসছি দেখে পালিয়ে গেল? এখন উপায়?
রামসুন্দর কিন্তু দমে যাবার পাত্র নয়। দিব্যকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, হাম কো আগে বাড়না। জরুর কুছ গোলমাল হো গেয়া !
যাই হোক, আমাদের যাত্রা আবার শুরু হল। এবারের পথ যেন আরো কঠিন, আরো চড়াই। গরমের কথা না হয় বাদই দিলাম। নেহাত আমাদের পোশাক আরব বেদুইন্দের মতো তাই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কাটা গাছ জামা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের শরীর স্পর্শ করতে পারছে না। মাঝে মধ্যে দু একটা জলের ইঁদারা পেয়েছি, কিন্তু আশে পাশে কোনো লোক তো দুরস্থান ডাকুদের ফেলে যাওয়া কিছুই দেখতে পেলাম না।
এক সময় মনে হচ্ছিল থেমে যাই। কী হবে ঘনশ্যামের দেখা পেলে? কী এমন পরমবীর চক্র অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য? চম্বল যাচ্ছি শুনে প্রেমিকার চোখের কোনে জল তো দেখিই নি, বরঞ্চ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেখেছিলাম। সম্পাদক মশাই গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, আর যাই হোক কাজটা সু সম্পন্য করে এসো।
তাহলে আমাদের কী এমন দেশ উদ্ধার করার দায় আছে যে এই প্রবল গরমে বুন্দেলখন্ডের ঘন জঙ্গলের মাঝখানে কে এক ডাকুবাবার খোঁজে শহিদ হব?
দিব্যকে এই কথা বলাতে ও খচে লাল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তোর সাংবাদিকতায় আসা উচিত হয়নি। মহাকরণে কেরানি হলে ভালো হত।
আজ চল্লিশ বছর বাদে ভাবি, কেনো হলাম না। নেহাত পেনশন তো পেতাম। বিড়ি খাওয়ার জন্য কারো কাছে হাত পাততে হত না।
কিন্তু সেই মুহূর্তে দিব্যর কথা বেশ গায়ে লেগে গেল।দিব্যর থেকে দশ কদম আগে আগে চড়াই শুরু করলাম। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।
পাহারের এই অংশটা উঠতে উঠতে বারবার একটা কথা মনে হচ্ছিল কেউ বা কারা যেন আগে এই পথে গেছে। এই ভাবনা কেনো এসেছিল মনে তা আজ আর মনে করতে পারি না। আমার মনের ভুল? হতে পারে। ভয় যে পাইনি তা নয়। তবু বয়েসের দোষে বা গুনে ভয়কে দমন করেছিলাম।
কে যেতে পারে? ডাকূ বা পুলিশ ? দু পক্ষকেই ভয়।
আমাদের অনন্ত যাত্রায় এক সময় হঠাতই ছেদ পড়ল। ক্যাপ্টেন রামসুন্দর আগে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ খানিকটা দূর থেকে হাত নেড়ে আমাদের দাঁড়িয়ে যেতে বলল। ঠোঁটে হাত রেখে সবাইকে চুপ করতে বলল। পুরো দলটা দাঁড়িয়ে গেল। শুধু তাই নয়, সবাই মাটিতে বসেও পড়লাম।
চারদিক স্তব্ধ। রামসুন্দর গুটি গুটি পায়ে পিছিয়ে এসে আমাদের ফিসফিস করে বলল, এদিকে এসো।
আমরাও তার পিছু পিছু গেলাম। রামসুন্দর মাটির দিকে দেখিয়ে বলল, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখো।
দেখলাম শুকনো ধুলোর মধ্যে স্পষ্ট জুতোর ছাপ। যে সে জুতো নয়, একদম খাটি হান্টার।
আমি আর দিব্য চোখে চোখে কথা বলে নিলাম। এখানে৪ আমরা ছাড়া আর কারোর পায়েই হানট্রার নেই, তবে? এ পথে তো আগে আসেনি।
বুঝলাম রামসুন্দর এই কথাটাই বোঝাতে চাইছে। আমাদের কানে কানে বলল, ডাকু লোগ ইধারই হ্যায়। এই জুতোর ছাপ ডাকু ছাড়া আর কারোর হতে পারে না। এই ছাপ সিগনাল। আপনারা চুপ চাপ বসে থাকুন। জল চাইলে ভিস্তি থেকে জল খেয়ে নেবেন। নড়া চড়ার কোনো চেষ্টা করবেন না। বিপদ হতে পারে। আমার দল আপনাদের পাহারা দেবে।
শুরু হল আমাদের অসহনীয় প্রতীক্ষা। ফাকা ধ্বংসস্তূপে ধোয়া দেখে মনে মনে ভেবেছিলাম, যাক বাবা ! ডাকাতরা পালিয়েছে। মনে মনে বেশ একটা তৃপ্তির স্বাদ অনুভব করেছিলাম। কিন্তু একি মুশকিল রে বাবা ! কমলি আমাদের ছাড়বেনা বলে যেন ঠিক করেই রেখেছে।
কিন্তু সদ্য চোখে দেখা হান্টারের ছাপ তো মিথ্যে হতে পারে না? তারপর রামসুন্দর যখন ওই ছাপ চিহ্নিত করেছে তখন ওরা ডাকাত না হলে যায় না। তবে উপায়?
প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা। আমাদের কপালে কী আছে জানি না।
দিব্য আবার সিগারেট খায় না। গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে হয়ত অর্থনীতির কোনো জটিল রহস্যের গিট ছাড়াচ্ছে। মৃত্যুর আগের মুহুর্তে মানুষ কি করে এতটা উদাসীন হয়ে থাকতে পারে তা আমার মতো মুক্ষু সুক্ষুর মাথায় ঢুকলো না।
সিগারেট ধরাতে গিয়ে একজন সহযাত্রীর প্রবল গালাগালির স্বীকার হলাম। ইহা সিগারেট মত পিও। ডাকু লোগ আসে পাসেই আছে। আমাদের পাত্তা ওদের জানা হোয়ে গেলে, দমাদ্যম গুলি চালিয়ে দেবে।
যা শালা এ কোথায় এলাম ? ডাকাত ধরতে না ধরা দিতে? আমরা তো আর পুলিশ নই, তবে? এ যাত্রায় আর রক্ষে পাবার জো নেই।
চা নেই, সিগারেট নেই, বাবা ঘনশ্যাম চাকুতে না গুলিতে মারবে, সে কথা ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম এলিয়ে এলো।
নিশ্চিন্তে ঘুমাবার কি জো আছে?
স্বপনে যে বাবা স্বয়ং খাড়া হতে দাড়িয়ে আছে। এক গাল দাড়ি। পাকানো গোঁফ পাকাতে পাকাতে বলছে, খাবো তোকে ঘ্যাচাং ফু:। আমি আপ্রান কাঁদতে-কাঁদতে বলছি, বাবা আমার ওজন মাত্র পঞ্চাশ কেজি। হাড্ডি বাদ দিলে বড় জোর তিরিশ । আমি তোমার জন্য কালীঘাটে দুটো জলহস্তী বলি দেবো। আমায় মেরনা বাবা।
ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা উত্তেজিত গলার আওয়াজে। চিৎকার কিন্তু চাপা। দেখলাম রামসুন্দর দিব্য কে কি জানি বোঝাচ্ছে।
আমি এগিয়ে গেলাম। শুনলাম, রামসুন্দর বলছে, বাবার কাছে তোমাদের সম্পর্কে খবর চলে গেছে। তোমরা যে পুলিশ লাইন থেকে আমার মারফত বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাও, সেটা বাবা জেনে গেছে। তাই তোমাদের বাবা বিশ্বাস করতে পারছে না। আমার দলে কেউ একজন গদ্দার আছে, যে বাবাকে এই খবর দিয়েছে। তাকে খুঁজে বার করতে হবে। এখন চল। পালাতে হবে।
দেখলাম আমার কমরেডের চোয়াল ঝুলে পড়েছে। চোখে হেরে যাওয়ার কষ্ট।
যে আমি কিছুক্ষণ আগেও ভাবছিলাম, বাবা ঘনশ্যাম দেখা না দিলেই ভালো। সেই আমার বুকের মধ্যে একটা পরাজয়ের গ্লানি ফিল করতে পারছিলাম।
এবার ফেরার পালা। একে তো ব্যার্থতার কষ্ট, তার উপর তীব্র গরমের ক্লান্তি। কি ভাবে যে নেমেছি, নিজেও জানি না। তবে শেষ একশো ফুট কারোর ঘাড়ে চেপে যে নেমেছি, সেটা জানি।
রামসুন্দর আমাদের অনুরোধ করল, দিন দুয়েক ওর গ্রামে থেকে যেতে। তাতে ক্লান্তি দুর হবে। আমাদেরও রাজি হতে হল। শরীর দিচ্ছিল না।
পরের দিন রাতে যে খবর পেলাম, সেটা গল্পের চাইতেই মারাত্মক।
ঘনশ্যামকে পুলিশ লাইন থেকেই জানানো হয়, আমরা ডিআইজির কাছের লোক। আমাদের সঙ্গে যেন বাবা কোনো ভাবেই দেখা না করে। খবরটা দিয়েছে সুখবিন্দর যার চিঠি নিয়ে আমরা এই গ্রামে এসেছিলাম, ডাকু ঘনশ্যাম এর সঙ্গে দেখা করতে।
আরো একটা খবর পেলাম, বাবা গ্রেফতার হয়েছে আমরা ফেরার ঠিক একদিন পরে।
একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, মঞ্জিলগড়ের ধোয়ার কারন কি সত্যি ডাকু না পুলিশ? সে প্রশ্নের উত্তর আজও পাইনি।
ভোপালে ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। দেখা করলাম বাঙালি আইজির সঙ্গে।
আমরা কোথায় গেছিলাম, বাবা ঘনশ্যাম কি দেখা দিয়েছিল ত জানার চেষ্টাও করলেন না, বাঙালি আইজি।
মুচকি হেসে বললেন, পরশু ফুলনের সঙ্গে দেখা করে এসো। আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি।
এখন আমাদের ডেস্টিনেশন গোয়ালিওর জেল।
এবার ফুলনের দেখা পাবো কি?
ক্রমশ