ফ্ল্যাট কিংবা জমি কিনবেন ভাবছেন ? আগে অবশ্যই জানুন
কলকাতা টাইমস :
দত্তবাবুর গোটা জীবনটা কেটেছে সরকারি ছোট্ট একটি কোয়ার্টারে। বাচ্চাগুলোকে কখনো ঘরের জানালা খোলা আকাশ দেখাতে পারেননি। পেনশনের টাকা দিয়ে ছোট্ট এক টুকরো জমি কিংবা একটা খোলামেলা ফ্ল্যাট কিনবেন- এটাই তার এক জীবনের সাধ।
এবার যখন চাকরি শেষে টাকাগুলো হাতে পেলেন, তখন স্বপ্নের ঘোর কেটে বাস্তব জগতে শুরুতেই খেলেন ধাক্কা। অসংখ্য দালাল, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি আর শত ‘বিশেষজ্ঞের’ হাজারো কথার ভিড়ে কোথায় যাবেন তিনি, কী করবেন এখন- ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। এই সমস্যার সমাধান কী? মুনির সাহেবের মতো অসংখ্য মানুষকে প্রতিনিয়ত জমিজমা বা ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে এমন হ্যাপা পোহাতে হয়।
এক টুকরো জমি বা একটি ফ্ল্যাট শুধু শৌখিনতা বা বিলাসিতা নয়, আপনার সারাজীবনের সম্বল হতে পারে এই সম্পদটুকু। কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করার আগে ভেবে নিন, টাকাটা ঠিক জায়গায় খরচ করছেন তো? জায়গা-জমি কেনাবেচার কাটখোট্টা ভাষা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? চলুন তবে আজ এক নজরে দেখে নেওয়া যাক জমি বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কোন বিষয়গুলো আপনার মাথায় রাখা উচিত, তার বিস্তারিত।
খতিয়ে দেখুন লাইসেন্স
আপনার যদি আগে কোনো স্থাবর সম্পদ কেনার অভিজ্ঞতা না থাকে, তবে নতুন এই ঘোরপ্যাঁচের জগতে যে কেউ আপনাকে ঠকানোর জন্য এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে জমি বা ফ্ল্যাট দেখার পরপরই সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পেপারওয়ার্কগুলো যাচাই করে নিন। অর্থাৎ আগে তারা কোথাও জমি বা ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে কিনা, করলে সেটি কোথায় বা কার কাছে করেছে এই বিষয়গুলো নিয়ে খোঁজ নিন। সেই সঙ্গে তাদের কাছে বিল্ডিং প্ল্যান পাশ করানো আছে কিনা তা নিজেই খতিয়ে দেখুন। নিজের চোখে জমি বা ফ্ল্যাটটি দেখে আসুন। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিন, এই জায়গাটি কি আসলে ওই বিল্ডার্স কোম্পানির, নাকি অন্য কারো সম্পত্তি তারা নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলেই এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারবেন।
ডেভেলপারদের কাছ থেকে নথিপত্র আদায় করে দেখে নিন তারা কি ভূমিস্বত্বের অধিকারী, নাকি অন্যের জমিতে কেবল বাড়ি বানিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে। যে জায়গাটিকে আপনার চিরস্থায়ী বসতি বানানোর পরিকল্পনা করছেন, তার মালিকানা পাওয়া নিয়ে কোনোরকমের ছাড় দেবেন না। প্রয়োজনবোধে জমিজমা নিয়ে কাজ করে এমন একজন উকিলকে সঙ্গে রাখতে পারেন। জমির কাগজে জায়গার নাম, ঠিকানা ইত্যাদি ভালো করে বুঝে নিন। যদি অন্য কারো ব্যক্তি মালিকানায় থাকা জমি কিনতে চান, তবে নিশ্চিত হয়ে নিন জমিটি কোনো ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেওয়া আছে কিনা। বন্ধকি জমির ক্ষেত্রে ‘রিলিজ সার্টিফিকেট’ বা ছাড়পত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নথি। তাছাড়া এক জমি একাধিক ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রি করাও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। জমি কেনার আগে দলিল-দস্তাবেজ অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে একবার পরখ করিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
নতুন করে জমি কেনার সময় আগের বছরগুলোতে জায়গাটির ‘প্রপার্টি ট্যাক্স’ ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কিনা তা দেখে নিন। ট্যাক্সের যাবতীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে নিজের জিম্মায় রাখুন। এটি আপনারই কাজে লাগবে সারাজীবন। তাছাড়া এই কাগজগুলোই প্রমাণ করে দেবে, আপনি কি কোনো জোচ্চোরের কাছ থেকে জমি কিনে কারো বকেয়া বিলের ঘানি টানতে যাচ্ছেন, নাকি দায়িত্বশীল কারো কাছ থেকেই আপনার ভবিষ্যত স্বপ্নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন।
খোঁজ নিন প্রজেক্টে কোন কোন ব্যাংক অর্থলগ্নি করছে
আজকাল আক্ষরিক অর্থেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে একের পর এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায় যে, এদের অনেকেই কাজ শুরু করার পরেও নগদ অর্থের অভাবে কাজ থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। দিনের পর দিন তখন অর্ধসমাপ্ত বা অসমাপ্ত বাড়িগুলো রাস্তার পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় অসমাপ্ত ওই বাড়ির কাঠামো দেখিয়েই আপনাকে একটি ফ্ল্যাট গছিয়ে দেওয়ার ধান্ধা করতে পারে এসব কোম্পানি। আপনাকে হয়তো বলা হবে, এখানে ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে তো ব্যাংক আপনাকে হাউজ লোন দেবে।
এ ধরনের ভুঁইফোড় কোম্পানির কাছে ঠকে যাবেন না যেন। কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই এমন অনেক কোম্পানির নামই বিভিন্ন ব্যাংকের ব্ল্যাকলিস্টে পড়ে আছে, যা আপনি খোঁজ না নিলে জানতেও পারবেন না। কাজেই ফ্ল্যাট কিংবা জমি দেখে কথা পাকাপাকি করার আগে তৈরি করে নিন ওই এলাকায় বা সংশ্লিষ্ট রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে আর্থিক সহায়তা দিতে ইচ্ছুক এমন ব্যাংকের তালিকা। আপনার পরিচিত কোম্পানির নামটি কোনো ব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত কিনা সেটা খবর নিন। তাছাড়া বেশ কিছু ব্যাংক ঘুরে নিজে গিয়ে কথা না বললে কোন ব্যাংক সবচেয়ে কম সুদে হাউজ লোন বা প্রপার্টি লোন দিচ্ছে, তা আপনি জানতে পারবেন না। কাজেই সশরীরে সরেজমিনে গিয়ে যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো হবে।
হিসাব রাখুন সার্বিক খরচের
‘আশপাশের জমির দাম এক লাখ করে, আপনাকে তো ভাই আশি হাজারে ম্যানেজ করে দিচ্ছি’- দালালদের এরকম কথায় খুশিতে ফেটে পড়ার কোনো কারণ নেই। নিজেই খোঁজ নিন আশপাশের জমি এবং ওই রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অন্য জমি কত দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রয়োজনে অন্য ক্রেতাদের খুঁজে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের কাছ থেকে জেনে নিন জমি বা ফ্ল্যাটের মূল্য বাদে উন্নয়ন ফি, কর্ণার প্লট বা পছন্দনীয় স্থানের জন্য আলাদা চার্জ, সার্ভিস ট্যাক্স, পার্কিং বা ক্লাবের জন্য কী পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ দিতে হতে পারে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছ থেকে লিখিতভাবে সার্বিক খরচের পরিমাণ জেনে নিন। সামান্য একটু সময় বাঁচানো কিংবা কষ্ট কমানোর জন্য কোম্পানিগুলোর কাছে একগাদা বাড়তি টাকা গচ্চা দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
যাচাই করে নিন সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটিকে
জমি কিনতে গিয়ে দুর্ভাগ্য থাকলে এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হয়ে যেতে পারেন, সেটি হলো, জমি কেনার পর আপনি আবিষ্কার করতে পারেন, আপনার কেনা জমিটি ইতিমধ্যেই আরও দু-তিনজন কিনে ফেলেছে! যে ফ্ল্যাটটি কীভাবে সাজাবেন বলে জীবনের মাঝবয়সে এসে কপোত-কপোতী বসে জল্পনা-কল্পনা করছেন, ফ্ল্যাটে উঠতে গিয়ে দেখতে পারেন, মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত সেই ফ্ল্যাটের মালিকানা মোটেও আপনাদের নয়। দালাল বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কথায় তাই কখনোই অন্ধবিশ্বাস করা যাবে না। কোম্পানিগুলো আগে কোথায় কাজ করেছে তা খতিয়ে দেখুন। তাদের প্রজেক্টগুলো সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসুন, আদৌ সেখানে কাজ হয় নাকি পুরোটাই ধাপ্পা। এখন ঘরে বসে অনলাইনে এসব তথ্য যাচাই করার সুযোগ থাকলেও প্রযুক্তির অপব্যবহার করতে পারে এমন মানুষেরও অভাব নেই। সুতরাং নিজের ঘামে ঝরানো টাকা লগ্নি করার আগে মাঠে নেমে দেখে আসুন, সঠিক মানুষের কাছে সেটা দিতে যাচ্ছেন কিনা।
কেনা বনাম ভাড়া দেওয়া
অনেকেই মনে করেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনে ভাড়াটিয়া উঠিয়ে দিলে মাসে মাসে ভাড়ার টাকা থেকেই ব্যাংকের ঋণ শোধ করা যাবে। এই ধারণাটি আসলে পুরোপুরি ঠিক নয়। ভাড়াটিয়া এসে ফ্ল্যাটে উঠলেও তো আপনাকে আপনার থাকার জায়গা বাবদ অন্য কোথাও টাকা গুণতে হচ্ছে। কাজেই হিসাবের খাতায় এখানে লাভের পরিমাণটা খুব বেশি হবে কিনা, সেটা একটু মিলিয়ে দেখুন। তাছাড়া আপনি ফ্ল্যাট কিনলেই যে সেখানে মনমতো ভাড়াটিয়া পেয়ে যাবেন, এমনও কোনো কথা নেই। কোনো কারণে কয়েক মাস বাসা খালি থাকলে বিপদে পড়বেন আপনিই। কাজেই ভাড়ার টাকায় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার পরিকল্পনা করার আগে হিসাব করে নিন আপনার হাতে কী পরিমাণ টাকা আছে। তা দিয়ে ভাড়াটিয়া না পেলে কতদিন ঋণ শোধ করতে পারবেন, সেটাও মাথায় রাখুন।
পরিকল্পনা হোক নিখুঁত
ডাউন পেমেন্ট থেকে শুরু করে ফ্লেক্সি পেমেন্ট পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ধারকৃত অর্থ পরিশোধের বেশ কিছু উপায় আছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু আলাদা আলাদা অঙ্কের সুদ গুণতে হয়। আপনি আপনার সাধ, সাধ্য ও সুবিধা অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনাটি গ্রহণ করুন। যেকোনো স্কিম গ্রহণ করার আগে তার আদ্যোপান্ত হিসাব করে নিন। তবে প্রতিটি কাগজপত্র যেন শতভাগ বৈধ থাকে, তা নিশ্চিত করুন নিজ দায়িত্বে।
আপনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং তাদের পছন্দ বা চাহিদা অনুযায়ী ফ্ল্যাট কিংবা জমির পরিমাণ নির্ধারণ করুন। বিল্ডিংয়ের প্ল্যান পাশ হওয়ার আগেই নিজের সুবিধা বিবেচনা করে সবকিছু যাচাই-বাছাই করে নিন।
আপনার এবং আপনার সন্তানের জন্য সারাজীবনের সম্পদটুকু অর্জন করার সময় তাতে যেন কোনো খুঁত না থাকে, তা নিশ্চিত করাটা কিন্তু আপনার পরম দায়িত্ব।