নামেই সাদা কিন্তু কুৎসিত এই ট্রেন বয়ে বেড়াত মৃত্য
কলকাতা টাইমস :
হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ক্ষত নিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের বুকে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলো নিজেদের বলয়ে নিতে শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। ইতিহাসে এই লড়াই শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত।
সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন আমেরিকা মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন বিষয়ে লড়াইয়ের পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও অলিখিত লড়াই শুরু হয়। উভয় দেশ বাছবিচার ছাড়াই একের পর এক পরমাণু বোমা ও ক্ষেপনাস্ত্র বানানো শুরু করে। এতে মার্কিন কর্তৃপক্ষ পড়ে ভিন্ন এক ঝামেলায়।
কারণ গণ্ডায় গণ্ডায় পরমাণু বোম তৈরির পর বোমা বহনে বিপাকে পড়ে আমেরিকা। সারাদেশের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে এই বোমা কীভাবে পৌঁছানো হবে সেই চিন্তায় ভাঁজ পড়ে বাঘা বাঘা সমরবীদদের কপালে। কারণ সাধারণ কোন ট্রাক বা সামরিক যানে এই বোমা বহন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া জেনেশুনে কোনো চালক এই মরণাস্ত্র দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যেতেও রাজি নন।
তবে কথায় বলে প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জনক। তাই আমেরিকার কর্তা ব্যক্তিরা যখন পরমাণু বোমা বহন করা নিয়ে চিন্তায় দিশেহারা তখন তাদের মাথায় চকিতে বুদ্ধি খেলে যায়। তারা সিদ্ধান্ত নেন অত্যাধুনিক যান নয়, একটি সাদামাটা ট্রেনে তারা এই বিধ্বংসী অস্ত্র বহন করবে। এতে সাধারণ মানুষের নজর এড়িয়ে বোমা বহন করা সম্ভব হবে। তাছাড়া ট্রেন যেহেতু একই ধরনের সমতল লাইনের ওপর দিয়ে চলবে, সেহেতু বোমা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকবে না।
যে সাদা রঙের ট্রেনে ওই সময় মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ পারমাণবিক বোমা বহনের সিদ্ধান্ত নেয়, ইতিহাসে সেটি ‘হোয়াইট ট্রেন’ নামে পরিচিত। নামে সাদা ট্রেন হলেও, কাজে ছিল কুৎসিত! কারণ এই ট্রেনের বাইরের দিকটা শুভ্রতার প্রতীক হলেও এতেই বহন করা হতো বিশ্বের সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্র পারমাণবিক বোমা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা বহনে বিশ্বখ্যাত অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের তৈরি বিশেষ ধরনের ট্রাক ব্যবহার করে। যার একটির দাম প্রায় এক মিলিয়ন ডলার। ট্রাকগুলোর নাম সেফগার্ড ট্রান্সপোর্টস বা এসজিটি। কিন্তু চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে প্রযুক্তি যখন এতটা উন্নত ছিল না, তখন পরমাণু অস্ত্র বহনে আমেরিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল হোয়াইট ট্রেন। ১৯৫৩ সালে সাদা ট্রেন প্রকল্পটি গৃহিত হয়েছিল। চালু ছিল প্রায় তিন দশক।
আমেরিকার রেলপথে চলাচলকারী অন্য আর দশটা ট্রেন থেকে সাদা ট্রেনের বাহ্যিক রূপের খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। সাদামাটা ছিল এর বগিগুলো। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, এতে কী বহন করা হচ্ছে! তবে বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ মনে হলেও এই ট্রেনের বগিগুলোতে ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত নিরাপত্তা রক্ষী থাকত। তারা সবসময় অস্ত্র তাক করে ট্রেন পাহারা দিত। সামান্য কারণে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা হলেই গুলি করার নির্দেশ ছিল তাদের ওপর।
ট্রেনগুলোর গতিও ছিল খুব কম। ঘণ্টায় মাত্র ৩৫ মাইল বেগে চলত। যা ওই সময়ে আমেরিকায় চলাচলকারী অন্য ট্রেনগুলোর তুলনায় খুবই কম গতিসম্পন্ন। ফলে ট্রেনগুলোর গন্তব্যে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লাগত। দেশের অধিকাংশ ট্রেনের গন্তব্য ছিল টেক্সাসের আমারিলো শহরের প্লানটেক্স প্ল্যান্ট। এটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি সামরিক স্থাপনা। ১৯৪২ সালে মার্কিন সামরিক কর্তৃক এই প্ল্যান্টেই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমার একমাত্র কারখানা।
সাদা ট্রেনের মাধ্যমে বেশ নির্বিঘ্নে এবং গোপনীয়তার সঙ্গে মার্কিন সামরিক বাহিনী সারাদেশে পারমাণবিক বোমা সরবরাহের কাজ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ট্রেনের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সাধারণ জনগণ জেনে যায় সাদা ট্রেন চলাচলের আসল উদ্দেশ্য। জাপানে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা ভাবিয়ে তোলে সাধারণ মার্কিনীদের। সারাদেশে এই ট্রেনে বোমা বহনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়।
আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। বেশ কয়েকবার শান্তিকামী জনতা এই ট্রেন চলাচলে বাধা দেয়। ফলে বেশ কয়েকবার কর্তৃপক্ষ ট্রেনের রং পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। তবে রং পরিবর্তনের কৌশল খুব বেশি কাজে আসেনি। কারণ আন্দোলনকারীরা এই ট্রেনের ধীরগতি, অস্ত্রে সজ্জিত গার্ড দেখে বুঝে ফেলত এটিই পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী ট্রেন। ফলে তারা এই নতুন রঙের ট্রেন চলাচলে বাধা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে ১৯৮৭ সালে পারমাণবিক বোমা বহনে সাদা ট্রেনের ব্যবহার বাতিল করে। তবে এখনও কিছু কিছু ট্রেন সমর জাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য রাখা আছে।