November 14, 2024     Select Language
৭কাহন Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

সেই সব শব বাহকেরা 

[kodex_post_like_buttons]

ভাবুক বাবুর ভাবনা

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল, সন্তোষ আর ঝুনু পাগলীরা ছিল। ননী ছিল, ঘড়িবাবু ছিলেন। মরা পোড়ানোর অনেক লোক ছিল। আজ আর তারা নেই। এখন বৃদ্ধরা বার্ধক্য সহ্য করতে না পারলে নিজেরাই শিবতলা পর্যন্ত টোটো করে গিয়ে চুল্লির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেই নিখরচায় স্বর্গবাস নিশ্চিত। এখন আর কেউ পোড়ে না। হিট থেরাপি করে গঙ্গায় ভেসে যায়। আমাদের মন্টুদা (নাম পরিবর্তিত) নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, দু’‌শো মড়া পোড়ালেই স্বর্গের ভিসা রেশন কার্ডে লিখে দেওয়া হবে। মন্টুদা খুবই উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী ছিলেন, মাঝেমাঝেই ট্যুরে যেতে হত। কিন্তু তিনি মোটেই অবিবেচক লোক ছিলেন না। গ্রামের কে কে উপর দিকে পা বাড়িয়ে আছে, খোঁজখবর নিয়ে তবেই বাইরে যেতেন। তবে তাতেও কী আর রেহাই আছে? ভটচাজ মশাই মরার আগে গোঁ ধরে বসলেন, মন্টু না ফেরা তক মরুম না। কী মুশকিল! প্রতি ঘন্টায় ডাক্তার আসছে, নাড়ি দেখছে। ভটচাজ মশাইয়ের জিভ প্রায় বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রতি দু ঘন্টায় হৃৎপিণ্ড থেকে ঢেকুরের মত কেমন একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। ডাক্তারবাবু ডেথ সার্টিফিকেট লেখেন কী করে? বিমর্ষ মুখে ডাক্তারবাবু বললেন, ওনার না মরার একটা কোনও গুহ্য কারণ আছে। কারণটা সবাই জানে– মন্টুদা। মন্টুদা না আসা পর্যন্ত ভটচাজ মশাই কিছুতেই মরবেন না। হেঁচকির গ্যাপ বাড়তে বাড়তে চব্বিশ ঘন্টা হল। তিনদিন কেটে গেছে। মন্টুদা স্টেশনে ল্যান্ড করেই সোজা ভটচাজ মশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে যেই না কাকাবাবু বলে ডাক ছেড়েছে, অমনি মুখে একটা স্বর্গীয় হাসি ঝুলিয়ে জীবনের শেষ হেঁচকিটা তুললেন ভটচাজ মশাই।

মন্টুদা কিন্তু ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারেননি। ১৮৫ তে এসে থেমে যেতে হয়েছিল। ব্যাড লাক। তখন শববাহী গাড়ি ছিল না, টেম্পো ম্যাটাডোর ছিল না। মরা খাটিয়ায় শুয়ে মানুষের কাঁধে চেপে শ্মশানে যেত। ওই কাঁধ দেওয়া ছিল পুণ্যের কাজ। আর মরা পোড়ানোতে পুণ্যি ডবল।

আমাদের বলাই মরা পোড়ানোর দলে খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি বলে খাটিয়ায় কাঁধ দেওয়ার কাজটাই বেছে নিয়েছিল। বলাই স্কুলের ৪/১০ টিমের বাঁধা সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিল। মাঠে ওকে প্রায় দেখাই যেত না। এত বেঁটে ছিল যে প্রায় অদৃশ্য অবস্থায়, একরকম হামাগুড়ি দিয়ে কত যে গোল করেছিল, তার হিসেব নেই। জয়দেব স্যার ওকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘‌বলাই, আর যাই হোস, লম্বা হবি না, তোকে এক ক্লাসেই পাঁচ বছর রেখে দেব। পরপর পাঁচ বার ট্রফি আমাদের চাই–ই। ব্যায়ামাগারে গিয়ে ওয়েট লিফটিং কর, আর কেউ মরেছে শুনলেই খাটিয়া কাঁধে নিয়ে নিবি, দেখবি লম্বা হওয়ার চান্সই পাবি না।’‌ তখন বলাই রীতিমতো সেলিব্রিটি। তারকাও বলা যেতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় সম্বর্ধনা পায়, সমাজে তারঅবদানের জন্য। তখন বুড়োবুড়িরা মরো মরো হলেই পোড়ানোর লোক রেডি করতে হত। পরিষ্কার দুটো লবি ছিল, মন্টু ও গোপাল (নাম পরিবর্তিত)। বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের কারও দাবি মন্টু, কারও গোপাল। গোপাল পোড়াত ভাল। কিন্তু মিশ্রবাবুর একটা মারাত্মক অভিযোগ ছিল গোপালের বিরুদ্ধে। একবার কুয়ো খোঁড়ার সময় গোপাল নাকি মিশ্রবাবুর কোদাল হাওয়া করে দেয়। অনেক চড় চাপড় মেরে, কাকুতিমিনতি করেও সেই কোদাল উদ্ধার হয়নি। মিশ্রবাবু গোপালকে শেষ হুমকি দিয়েছিলেন, ‘আমার মড়া তুই সাজাবি না।’‌ গোপালকে এই কথা বলতে পেরে উনি প্রভুত তৃপ্তি পেয়েছিলেন। সে দিনই গিয়ে তিনি মন্টুদাকে বুক করে এসেছিলেন।কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! মিশ্রবাবুর আগেই গত হলেন মন্টুদা। মিশ্রবাবু দুই ছেলেকে শাসিয়ে রাখলেন, গোপালের হাত যেন আমার চিতায় না লাগে। এক্সপার্ট লোক পাওয়া না গেলে বাড়িতেই কবর দিয়ে দিবি। কিন্তু না পোড়ালে যদি বাবা পরলোকে না যান, এই ভেবে মিশ্রবাবুর মৃত্যুর পর সেই গোপালকেই ডাকা হল। গোপাল গদগদ ভাবে চিতার কাঠ সাজিয়ে সবে মড়ার মুখের কাছে শেষ কাঠটা গুঁজতে যাবে, অমনি মিশ্রবাবুর রুগ্ন হাতের বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় এসে পড়ল গোপালের গালে। মরা চিৎকার করে বলল, হারামজাদা, ব্যাটা কাটমানি খেয়ে কোদালটা বেচে দিলি? সেই থেকে গোপাল আর চিতা সাজায় না, অনুষ্ঠান বাড়িতে ফুল সাজায়। ডেড বডি দেখলেই চট করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখ ছলছল করে। সেই গোপালকে হঠাত দেখা গেল নতুন করে মরা পোড়ানোর দলে। এই কয়েকদিন আগে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিল, ভাই গোপাল, আবার তুই মরা পোড়াচ্ছিস? গোপাল গর্বের হাসি হেসে বলে, মিশ্রদাদু স্বপ্নাদেশে বলেছেন, গোপাল এখন থেকে জানোয়ার পার্টি কর। মানুষ মারবি আর পোড়াবি। ভাতে মারবি। প্রানেও মারবি।সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ফাঁকা জনসভার মঞ্চে নাকি গোপালকে দেখা গেছে। মরা খুঁজতে।‌‌

Related Posts

Leave a Reply