রক্তাক্ত ইতিহাস সত্বেও মহার্ঘ বন্দির দেহ কেটে আঁকা এই বই
অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে জরুরি মুহূর্তে বিংশ শতকের একটি অ্যানাটমি গ্রন্থের সহায়তা নেন নার্ভ সার্জন ড. সুজান মেককিনন। গ্রন্থটির সহায়তা তিনি প্রায়শই নিয়ে থাকেন। হাতে আঁকা জটিল সব চিত্র সম্বলিত এই গ্রন্থে রয়েছে মানবদেহের বিস্তারিত খুঁটিনাটি। রয়েছে পরতের পর পরতে আঁকা মানব শরীরের সচিত্র উপস্থাপন।
‘পার্নকপ্ফ টোপোগ্রাফিক অ্যানাটমি অফ ম্যান’ বা পার্নকপ্ফ প্রণীত মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সচিত্র বিবরণ সম্বলিত এই গ্রন্থটিই দুনিয়ার সেরা সচিত্র অ্যানাটমি পুস্তক হিসেবে বিবেচিত। মানবদেহের চামড়া, পেশি, শিরা-উপশিরা, স্নায়ু, দেহের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গ ও হাড় চিত্রের সাহায্যে বিস্তারিত ভাবে এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কিন্তু পার্নকপ্ফের বইটি এখন আর বাজারে নেই। তাই, কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থের পুরনো একটি সেট নিজের সংগ্রহে রাখতে এমনকি কয়েক হাজার পাউন্ড খরচ করতেও দ্বিধা করেন না আগ্রহীরা। চড়া মূল্যের এই গ্রন্থ কেউ কেউ ক্লিনিকে, গ্রন্থাগারে বা বাড়িতে সাজিয়ে রেখে প্রদর্শন করে।
তবে এই বইয়ের আছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস। নাৎসিদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে গবেষণালব্ধ ফল সন্নিবেশিত হয়েছে এই গ্রন্থের হাজার-হাজার পৃষ্ঠাজুড়ে।
সমালোচকেরা মনে করেন, গ্রন্থটির যেহেতু কালো ও মর্মান্তিক এক ইতিহাস রয়েছে তাই এটি ব্যবহারের প্রসঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত।
ড. মেককিনন বলছিলেন, বইটির ইতিহাস তাকে অস্বস্তি দেয়। কিন্তু এই বইয়ের সহায়তা ছাড়া অনেক সময় সে নির্ভুলভাবে কাজই করতে পারে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি রাব্বি জোসেফ পোলক। হেলথ ল’ বিষয়ের এই অধ্যাপক পার্নকপ্ফের এই গ্রন্থটিকে একটি ‘মোরাল এনিগমা’ বা ‘নৈতিক ধাঁধা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অধ্যাপক পোলকের মতে, গ্রন্থটিকে নৈতিক প্রহেলিকা বা ধাঁধা হিসেবে বর্ণনা করার কারণ হচ্ছে, বইটির একদিকে রয়েছে এক জঘন্য ইতিহাস, অন্যদিকে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের কল্যাণে। নাৎসিবাদী খ্যাতিমান ডাক্তার এডুয়ার্ড পার্নকপ্ফের ২০ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প ছিল এই অ্যানাটমি গ্রন্থ। সহকর্মীদের ভাষ্যানুযায়ী, পার্নকপ্ফ ছিলেন নাৎসিবাদের উগ্র সমর্থক। এমনকি কর্মস্থলেও তিনি রোজ নাৎসি ইউনিফর্ম বা উর্দি পরে যেতেন। তাকে যখন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের ডিন পদে নিয়োগ দেয়া হয় তখন তিনি সকল ইহুদি সহকর্মীদের বরখাস্ত করে দেন। বরখাস্তদের মধ্যে এমনকি তিনজন নোবেল বিজয়ীও ছিলেন।
১৯৩৯ সালে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে বলা হয়, বন্দিদেরকে হত্যা করার পরপরই গবেষণা ও শিক্ষা কাজের জন্য তাদের দেহগুলোকে নিকটস্থ অ্যানাটমি বিভাগে জমা দিতে হবে।
সেই সময় ড. পার্নকপ্ফ দিনে ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করতেন। মৃতদেহগুলো একের পর এক ব্যবচ্ছেদ করতেন। আর তার সাথেই থাকতো একদল আঁকিয়ে। তারা সেগুলোর ছবি আঁকতেন।
মৃতদেহ দিয়ে অ্যানাটমি বিভাগগুলো কখনো-কখনো উপচে উঠতো। বিভাগগুলোতে আর মৃতদেহের স্থান সংকুলান হবে না দেখে এমনকি কখনো কখনো বন্দি শিবিরগুলোতে হত্যাকাণ্ড সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সেবিন হিল্ডাব্র্যান্ডট বলছিলেন, পার্নকপ্ফের গ্রন্থে যে ৮০০ চিত্র রয়েছে তার মধ্যে অন্তত অর্ধেকই এসেছে রাজনৈতিক বন্দিদের থেকে। এইসব বন্দিদের তালিকায় সমকামি নারী-পুরুষ, জিপসি, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি ও ইহুদিরা ছিলেন।
এই এটলাসের প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ হয় ১৯৩৭ সালে। বইটিতে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে এরিখ লেপিয়ের ও কার্ল এন্ডট্রেসের স্বাক্ষর এবং স্বস্তিকা চিহ্ন রয়েছে।এমনকি ১৯৬৪ সালে ইংরেজি ভাষায় দুই খণ্ডে গ্রন্থটির যে সংস্করণ বের হয় সেখানেও আদি স্বাক্ষর ও নাৎসি চিহ্ন ছিল। পরবর্তীতে নাৎসি চিহ্ন ঢেকে দেয়া হয়। এর হাজার হাজার কপি দুনিয়াজুড়ে বিক্রি হয়েছিল এবং অনূদিত হয়েছিল পাঁচটি ভাষায়। বইটির মুখবন্ধে এটিকে ‘দুর্দান্ত অঙ্কন সম্বলিত সচিত্র একটি অসাধারণ শিল্প’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু একটি বারের জন্যেও উল্লেখ করা হয়নি এর পেছনের রক্তাক্ত অতীত।
১৯৯০ দশকের দিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা প্রথম প্রশ্ন করতে শুরু করে যে, এই গ্রন্থে যাদের ছবি অঙ্কন করা হয়েছে তারা কারা?
অতঃপর গ্রন্থটির কালো ইতিহাস প্রকাশ পাবার পর ১৯৯৪ সালের দিক থেকে বইটি আর বাজারে পাওয়া যায় না।
রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন্স বলেছে, গ্রন্থাগার বা ইতিহাসের প্রয়োজন ছাড়া ইংল্যান্ডে গ্রন্থটি ব্যবহার করা হয় না।
তবে, নিউরোসার্জারি করেন এমন নার্ভ সার্জনদের মধ্যে করা সাম্প্রতিক এক জরিপে ফলে দেখা যাচ্ছে, ৫৯% ডাক্তারই বইটির অতীত সম্পর্কে জানে। আর জেনেও ১৩% ডাক্তারেরা বইটি ব্যবহার করছে।
জরিপে অংশ নেয়া সার্জনদের মধ্যে ৬৯% বলেছেন, বইটির ইতিহাস জানার পরও তাদের সেটি ব্যবহার করতে অস্বস্তি হয় না।
কিন্তু ইতিহাস জানার পর গ্রন্থটি ব্যবহারে ১৫% সার্জনের অস্বস্তি বোধ হয় বলে জানা গেছে। আর এই গ্রন্থের ব্যবহার নিয়ে বাকি ১৭% সার্জনের অনুভূতি অস্পষ্ট অর্থাৎ নিজেদের মত নিয়ে তারা রয়েছেন সিদ্ধান্তহীনতায়।
ড. মেককিনন বলছিলেন, জটিল অপারেশনের ক্ষেত্রে ছোটো ছোটো নার্ভ খুঁজে পেতে বইটি দারুণ সহায়ক। তবে, এই বইয়ের সহায়তা নিলে তিনি গ্রন্থটির অন্ধকার অতীত সম্পর্কে সকলকে জানিয়ে নেন বলে উল্লেখ করেন।
বইটির ব্যবহার নিয়ে গত বছর এক ধরনের মতৈক্যে পৌঁছান রাব্বি পোলক এবং চিকিৎসা ইতিহাসবিদ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইকেল গ্র্রোডিন।
তারা বলেন, মানুষের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে গ্রন্থটির ব্যবহার হতে পারে। তবে, এই এটলাসের অন্ধকার ইতিহাস সম্পর্কে অবশ্যই অপারেশনের আগে সকলকে জানাতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পার্নকপ্ফকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয়। যুদ্ধবন্দী হিসেবে তিন বছর তিনি হাজতবাসও করেন। কিন্তু পরে তার বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। পরে তিনি মুক্তি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে পুনরায় এনাটমি গ্রন্থের কাজে মনোনিবেশ করেন এবং ১৯৫২ সালে তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করেন। ১৯৫৫ সালে গ্রন্থটির চতুর্থ খণ্ড প্রকাশের ঠিক আগে-আগে তিনি মারা যান।
অ্যানাটমি এটলাস প্রকাশের পর কেটে গেছে ৬০ বছরের অধিক কাল। অথচ মানব শরীরের অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে এখনো এটিই সেরা সচিত্র গ্রন্থ বলে মনে করেন এনাটমির শিক্ষক ড. হিল্ডেব্র্যান্ডট।
ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োএথিস্ট ড. জোনাথন আইভিস বলছিলেন, এই গ্রন্থে রয়েছে বিস্ময়কর বিশদ চিত্রাবলী। কিন্তু এই বইয়ে লেগে আছে এক ভয়ানক ইতিহাস। তাই, এই গ্রন্থ ব্যবহার করে উপকার বা সুবিধা নিলে সেই অন্যায়কেই কোনো না কোনোভাবে সমর্থন করা হয় বলে তিনি মনে করেন। তবে, ব্যবহার না করলে গ্রন্থটি যে হারিয়ে যাবে সে বিষয়ে তিনি উল্লেখ না করে পারেন না।
আর ড. মেককিননের মতে, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুবিধার জন্য যে উপকরণই পাওয়া যায় তিনি সেটির সহায়তা নেওয়ার পক্ষে। তাছাড়া তিনি মনে করেন, এই এনাটমি এটলাস যদি কালের গর্ভে হারিয়ে যায় তাহলে নার্ভ বা স্নায়ুর অপারেশনের সুবিধাদি যেনো বহুযুগ পিছিয়ে পড়বে।