করোনার ‘শেষ’ কথা একমাত্র টিকাই
কলকাতা টাইমস :
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই টিকা গ্রহণের ব্যাপারে সবাই সমান সচেতন নয়। অনেকেই এ ব্যাপারে উদাসীন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এই প্রবণতা নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন যে তারা ‘করোনার টিকা অসচেতনাকে’ ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য ১০টি চরম হুমকির মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে ঘোষণা করেছে। যখন রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন অবশ্যই রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচিও চালিয়ে যেতে হবে।
মহামারি রোগ ও টিকা
মহামারি রোগ এমন একটি রোগ, যা নির্দিষ্ট জনপদের বিশাল অংশের জনগোষ্ঠীকে একবার আক্রান্ত করা শুরু করলে সাধারণত ৭০-৮০ শতাংশ লোককে অসুস্থ না করে ক্ষান্ত হয় না। মহামারির চরিত্রই হলো, যদি টিকা না নেওয়া হয়, সমাজে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত প্রাকৃতিক নিয়মেই রোগটির একটার পর একটা ঢেউ এসে মানবসমাজকে ধ্বংস করতে থাকবে। তত দিনে অনেক মূল্যবান জীবনসম্পদ বিদায় নেবে।
‘হার্ড ইমিউনিটি’ দুইভাবে তৈরি হয়। একটি হলো ন্যাচারাল ইনফেকশন এবং অন্যটি কৃত্রিমভাবে ব্যাপক টিকা দিয়ে সমাজকে হার্ড ইমিউনিটির আওতায় নিয়ে আসা। তাই টিকার মাধ্যমেই সমাজকে জীবনসম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
টিকা কী?
টিকা হলো একটি নির্দিষ্ট রোগজীবাণুর এমন একটি দুর্বল জীবিত সামান্য অংশ বা মৃত পুরো অংশ অথবা ভাইরাসের জেনেটিক কোড, যা মানবশরীরে প্রবেশ করিয়ে তার ইমিউন সিস্টেমকে এই ভাবে শিখিয়ে রাখা হয় যেন ইমিউন সিস্টেম সেই রোগজীবাণুকে অ্যান্টিজেন বা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার বিরুদ্ধে আগাম অ্যান্টিবডি ও মেমরি সেল তৈরি করে রাখে। যেন ভবিষ্যতে একই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে তৈরীকৃত এই অ্যান্টিবডি ও মেমরি সেল ব্যবহার করে রোগজীবাণুটিকে মেরে ফেলতে পারে। অথচ এক শ্রেণির মানুষের ধারণা টিকায় কোনো লাভ হবে না।
শতভাগ নিশ্চয়তা নেই
টিকা নিলেই শতভাগ নিরাপত্তা বা কখনো করোনা হবে না—এমন ধারণা ভুল। কোনো টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যখন বলে যে তাদের টিকা ৯০ শতাংশ কার্যকর তার মানে হলো, তারা যে নির্দিষ্ট টিকাটি বাজারে ছড়েছে সেটি ১০০ জনকে প্রয়োগ করলে ৯০ জনের করোনা হবে না বলে তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রমাণ পেয়েছে। বাকি ১০ জন করোনাক্রান্ত হবে না এই নিশ্চয়তাও নেই। কিন্তু এই নিশ্চয়তা অবশ্যই আছে যে যদিও বা করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে তা মারাত্মক হবে না।
মনে রাখতে হবে, টিকা কখনো রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না; কিন্তু সংক্রমিত হলে আগেই টিকাগ্রহীতার শরীরে তৈরীকৃত অ্যান্টিবডি তাকে সুরক্ষা দেয়।
টিকার কার্যকারিতা
ভ্যাকসিন বা টিকার কার্যকারিতা নির্ভর করে তিনটি ফ্যাক্টরের ওপর। এগুলো হলো, রোগজীবাণু ফ্যাক্টর, রোগী বা হোস্ট ফ্যাক্টর ও ভ্যাকসিন ফ্যাক্টর। তাই—
* সব সংক্রামক রোগের ওপর সব টিকা সমানভাবে কার্যকর হয় না। কেননা একেক সংক্রামক রোগের সংক্রমণ ও রোগগ্রস্ত করার ক্ষমতা, মিউটেশন, পারঙ্গমতা ইত্যাদি একেক রকম।
* যে ভাইরাস যত ঘন ঘন এবং যত প্রতিকূল পরিবেশে মিউটেশন করে যত বেশি ভেরিয়েন্টে রূপান্তরিত হবে, তার বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা তত চ্যালেঞ্জিং হবে। এ জন্যই করোনাভাইরাস টিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে তার ঘন ঘন ভেরিয়েন্ট পরিবর্তনের কারণে।
* কোনো কোনো ভাইরাস মানুষকে একবার আক্রান্ত করলে সারা জীবন আর আক্রান্ত করে না। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সারা জীবনের জন্য ন্যাচারাল অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। ফলে জীবনে একবার ভ্যাকসিন দিলেও তা সারা জীবন কার্যকর থাকে। তবে বুস্টার ডোজ দিলে আরো শক্তিশালী হয়। যেমন— Herpes and Measles ভাইরাস।
কিন্তু কভিড-১৯ এমনই এক মারণঘাতী রোগ, একবার আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে ওঠার পর তৈরীকৃত অ্যান্টিবডি ছয় থেকে আট মাসের বেশি স্থায়ী হয় না। ফলে করোনার হাত থেকে বাঁচতে হলে প্রতিবছরই টিকা নিতে হবে।
* ভাইরাসের ভেরিয়েন্ট পরিবর্তনের ফলে ব্রেকথ্রু ইনফেকশন (ফুল ডোজ টিকা নেওয়ার ১৪ দিন পর আবারও কভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হওয়া) ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রেই বেশির ভাগ ঘটছে।
* এ রকম ডেল্টা ভেরিয়েন্টের আগমন মানবজাতির জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ।
* এই করোনাভাইরাসকে যত বেশি সংক্রমণের সুযোগ দেওয়া হবে, সে তত বেশি ভেরিয়েন্ট পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। যত বেশি ভেরিয়েন্ট পরিবর্তনের সুযোগ পাবে, তত ব্রেকথ্রু ইনফেকশনের হার বাড়বে। আর যত ব্রেকথ্রু ইনফেকশন বাড়বে, তত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমবে এবং বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যা, কমবে মানুষের আস্থা।
টিকার কিছু বিশেষ দিক
* কোনো কোনো টিকায় নারী, কোনো কোনো টিকায় পুরুষরা বেশি রেসপন্স করে। যেমন—ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস-এ ও হেপাটাইটিস-বিতে নারীদের অ্যান্টিবডি প্রডাকশন রেসপন্স ভালো; কিন্তু টিটেনাস ও হামের টিকার ক্ষেত্রে পুরুষদের অ্যান্টিবডি রেসপন্স ভালো।
* কো-মর্বিডিটি বা ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, এইচআইভি ইত্যাদি ধরনের রোগে কম অ্যান্টিবডি তৈরি হয় অথবা হয় না বলে টিকা দিলেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
* অন্য রোগজীবাণু দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলে যেমন—ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি এবং অনেক বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ও ইমিউনো সাপ্রেসিভ ড্রাগ ব্যবহাররত অবস্থায় থাকলে অ্যান্টিবডি রেসপন্স কমে যেতে পারে।
* যার ইমিউন সিস্টেম যত শক্তিশালী, অথবা স্বাভাবিক ইমিউন সিস্টেমের অধিকারী একজন যত মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হবে, সংশ্লিষ্ট টিকায় তার তত অ্যান্টিবডি তৈরি হবে।
* আগে আক্রান্ত হয়ে একটি সংক্রামক রোগ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই রোগের টিকা তার জন্য অনেক বেশি কার্যকর ও স্থায়ী।
* মাঝারি ধরনের শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন পরিচালনা, পুষ্টিকর খাবারে অভ্যস্তদের অ্যান্টিবডি রেসপন্স ভালো থাকে।
* গবেষণায় ধূমপায়ী, হেপাটাইটিস-বি, মদ্যপ ব্যক্তিদের টিকায় কম কার্যকারিতা দেখা গেছে।
* উন্নয়নশীল বিশ্বে শিশুর ডিপথেরিয়া এবং উন্নত বিশ্বে শিশুর হাম, যক্ষ্মার জন্য বিসিজি, পোলিওর জন্য ওপিভি টিকায় ভালো রেসপন্স দেখায়।
কার্যকারিতা নির্ভর করে যেভাবে
* ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কোন অবস্থার ওপর টিকা তৈরি হবে, যেমন—এটা কি লাইভ এটেনিউয়েটেড ভ্যাকসিন, কিল্ড ভ্যাকসিন, প্রোটিন ভ্যাকসিন, সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন নাকি জেনেটিক কোড ভ্যাকসিন ইত্যাদির ওপরও টিকার কার্যকারিতা নির্ভর করে।
* সাধারণত লাইভ ভ্যাকসিন বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী, যা এক ডোজেও কাজ হয়। কিন্তু কিল্ড ভ্যাকসিন কম শক্তিশালী ও স্বল্পস্থায়ী, যাতে দুই ডোজ, এমনকি বুস্টার ডোজও লাগে।
* একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুই ডোজের মাঝের ব্যবধান যত বেশি, টিকার কার্যকারিতা তত বেশি।
* টিকার কার্যকারিতা অনেকটাই ডোজ নির্ভর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্তত দুই ডোজ, এমনকি কার্যকারিতা সব সময় অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে নির্দিষ্ট ব্যবধানে বুস্টার ডোজও দিতে হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দুই ডোজ দেওয়ার পরও বছর বছর বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে।
* সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ও কোল্ড চেইন রক্ষিত না হলে অ্যান্টিবডি রেসপন্স কম হয়।
টিকায় যা থাকে
অনেকে মনে করেন, করোনার টিকা নিলে এর উপসর্গ খুব মারাত্মক হতে পারে। বিষয়টা আসলে তেমনটি নয়। তার আগে বুঝতে হবে টিকার ভেতরে কী থাকে?
করোনা টিকায় বা ভ্যাকসিনে থাকে মৃত করোনাভাইরাস, জীবিত কিন্তু দুর্বল করা করোনাভাইরাস, করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন, নিউক্লিউক্যাপসিড প্রোটিনের অংশ অথবা ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান। এদের কোনো একটি শরীরে ঢোকার পর রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই।
টিকা নিয়ে ভ্রান্তি নয়
কোন দেশের টিকা ভালো আর কোন দেশেরটা খারাপ, এ ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। টিকা উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারে আসার অনুমতি সবই সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার দিয়ে থাকে। ওই টিকা অন্য দেশে ব্যবহার করার আগে সেই দেশের সরকার দেখে, এটার কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, উন্নত বিশ্ব তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইত্যাদির অনুমোদন আছে কিনা।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ছাড়া কোনো বড় কম্পানির পক্ষেও উৎপাদনে যাওয়ার মতো জটিল ও সময়সাপেক্ষ এমন প্রকল্পের চিন্তা করা সম্ভব নয়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
প্রতি টিকারই কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এর কারণে হয়তো মানুষের অনীহা কাজ করে। কিন্তু টিকা না দিলে করোনায় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে—এর চেয়ে কি টিকা নেওয়া উত্তম নয়? তবে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে মৃত্যুর আশঙ্কা কিন্তু নেই।
আপনি কেন টিকা নেবেন?
টিকা হলো এই গ্রহে সংক্রামক রোগ প্রতিহত করার সহজতম, সাশ্রয়ী ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। যদি জনসংখ্যার একটা বড় অংশ টিকা নেয়, তাহলে রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। ফলে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, অতিশয় দুর্বল তারাও রোগের কবল থেকে রক্ষা পায়। এ ছাড়া—
* টিকা গ্রহণ মানুষকে কোনো না কোনো পর্যায়ের সুরক্ষা দেবেই।
* টিকা নিয়ে কেবল আপনিই সুরক্ষিত হচ্ছেন না, বরং অন্যকেও সুরক্ষা দিচ্ছেন।
* কভিড-১৯ একটি ছোঁয়াচে সংক্রামক রোগ। ৮০ শতাংশ লোকের টিকা দিয়েই হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা সম্ভব। তখন সমাজের যারা দুর্বল, সংগত কারণেই টিকা নিতে পারেনি; তারাও টিকা ছাড়াই সুরক্ষা পাবে।
* যত দ্রুত গণটিকা, তত দ্রুত স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা।
* টিকা গ্রহণে যত দেরি করবেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের হুমকিতে তত বেশি পড়বেন।
* টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অল্প ও সাময়িক; কিন্তু টিকা না দিলে মৃত্যুঝুঁকি অধিক।
* সামান্য অ্যালার্জি বা সর্দি হলে টিকা গ্রহণে নেই কোনো বিপত্তি।
* গর্ভবতী, দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ মা ও আবালবৃদ্ধবনিতা চিকিৎসকের পরামর্শে টিকা নিতে পারে।