কম করে ৩০ টি প্রেমের পরেও ব্যর্থ, রানির বোনের শেষ পরিণতি ছিল ভয়ঙ্কর!
রাজ্ পরিবারের জাতক হয়েও সিংহাসন দূরেই থেকে যায় বেশির ভাগের কাছে। রাজকুমারি মার্গারেটও আজীবন ছিলেন সেই দলে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বোন ছিলেন ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। তার বর্ণময় জীবন সবসময়ই ছিল বোন দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছায়ায় ঢাকা।
স্কটল্যান্ডের গ্ল্যামিস প্রাসাদে নিজের মামাবাড়িতে মার্গারেটের জন্ম ১৯৩০ সালের ২১ আগস্ট। রাজ পরিবারে তিনি ছিলেন সকলের আদরের ‘মার্গট’। জন্মের পর ইচ্ছা করেই স্থানীয় গির্জায় মার্গটের নাম দেরিতে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। যাতে ধারাবাহিকতার ক্রম অনুসারে ‘১৩’ সংখ্যাটা এড়ানো যায়।
তার মা ডাচেস অব ইয়র্ক চেয়েছিলেন ছোট মেয়ের নাম রাখবেন ‘অ্যান মার্গারেট’। তবে তার দাদু রাজা পঞ্চম জর্জের নাতনির এই নাম পছন্দ হয়নি। পরিবর্তে তিনি নামকরণ করেছিলেন ‘মার্গারেট রোজ’। তার শৈশব কেটেছিল লন্ডন এবং উইন্ডসরের প্রাসাদে। গুজব রটেছিল, রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং রানি এলিজাবেথের ছোট মেয়ে মূক ও বধির। পরে ১৯৩৪ সালে কাকা যুবরাজ জর্জের বিয়ের আসরে মার্গটকে দেখে সকলের ভুল ভাঙে।বোনের সঙ্গে মার্গারেটেরও লেখাপড়া শুরু হয়েছিল প্রাসাদের অন্দরমহলেই। শোনা যায়, মূলত মায়ের ইচ্ছাতেই গভর্নেসের তত্ত্বাবধানে চলত দুই বোনের পড়াশোনা। বাকি পাঁচজন বাচ্চার মতো স্কুল যেতে না পারার দুঃখ আজীবন সঙ্গী ছিল মার্গারেটের। এর জন্য তিনি নিজের মাকেও দোষারোপ করেছেন। তবে পরবর্তীতে রানি এলিজাবেথের দাবি ছিল, রাজকন্যাদের অন্তঃপুরে রেখে পড়াশোনা করানোর সিদ্ধান্ত ছিল তাদের দাদু পঞ্চম জর্জের। সেই নির্দেশই অনুসরণ করা হয়েছে।
দাদুকে অবশ্য বেশি দিন পাননি দুই রাজকন্যা। মার্গারেট যখন ৫ বছরের, মারা যান তাদের দাদু রাজা পঞ্চম জর্জ। এরপর সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন পঞ্চম জর্জের বড় ছেলে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড। কিন্তু তার রাজত্বকাল ছিল মাত্র এক বছরের। তারপরই তিনি সিংহাসনচ্যুত হন নিজের প্রেমের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে।
আমেরিকান সুন্দরী ওয়ালিস সিম্পসনের প্রেমে পড়েছিলেন অষ্টম এডওয়ার্ড। কিন্তু সাধারণ পরিবারের তরুণী তথা দু’বারের ডিভোর্সি ওয়ালিসকে ব্রিটেনের মহারানী বলে মানতে রাজি ছিল না রাজপরিবার। চার্চ অব ইংল্যান্ড এবং তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার (ডোমিনিয়ন গভর্নমেন্ট), দুই পক্ষ থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ওয়ালিসকে মহারানী হিসেবে মেনে নেওয়া হবে না।
রাজসিংহাসন এবং প্রেয়সীর মধ্যে অষ্টম এডওয়ার্ড বেছে নিয়েছিলেন দ্বিতীয়টিকেই। ১৯৩৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি সিংহাসনচ্যুত হন। ব্রিটেনের রাজা হন তার ভাই রাজা ষষ্ঠ জর্জ। এর পর বাবা-মা এবং বোনের সঙ্গে মার্গারেট চলে আসেন বাকিংহাম প্রাসাদে। উত্তরাধিকারসূত্রে বিশ্বের অন্যতম সেরা এই প্রাসাদ হয়ে ওঠে তাদের বাসস্থান।
দুই মেয়েই ছিলেন রাজা ষষ্ঠ জর্জের অত্যন্ত প্রিয়। বড় মেয়েকে তিনি বলতেন তার ‘গর্ব’। ছোট মেয়ে ছিলেন তার ‘আনন্দ’। এভাবেই বর্ণনা করতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার কারণে দুই রাজকন্যাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বালমোরাল প্রাসাদে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা ফিরে আসেন বাকিংহামে।
১৯৪৭ সালে বিয়ে হয়ে যায় বোন এলিজাবেথের। পরের ৩ বছরের মধ্যে তিনি চার্লস এবং অ্যানের মা। ব্রিটিশ সিংহাসন থেকে আরও কিছুটা দূরে চলে যান মার্গারেট। সিংহাসন থেকে দূরত্ব বাড়লেও অভিজাত মহলে তিনি ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। ব্যক্তিত্ব এবং সৌন্দর্যের জন্য তার উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে থাকত সমাজের অভিজাত অংশ।
বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন নাচের আসর, নাইটক্লাব এবং পার্টিতে মার্গারেটের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। ইউরোপের অভিজাত মহলে মার্গারেটের অনুরাগীর সংখ্যা এত বেশি ছিল, তাকে বলা হত ‘মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর গার্ল’! অন্তত ৩০টি প্রণয়ের গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল তাকে ঘিরে। তারপরেও কমেনি অনুরাগীদের সংখ্যা।
১৯৫১ সালে মার্গারেটের ২১তম জন্মদিনের কয়েক মাস পরেই তার বাবা ফুসফুসের ক্যানসারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবার নির্দেশে মার্গারেটকে কিছু রাজকর্তব্য পালন করতে হয়। কর্কটরোগের বিরুদ্ধে ৫ মাসের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রয়ারি মারা যান রাজা ষষ্ঠ জর্জ। সিংহাসনে বসেন তার বড় মেয়ে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
পিতৃবিয়োগের পরে আবার ঠিকানা বদল। মাকে নিয়ে মার্গারেট চলে গেলেন ক্ল্যারেন্স হাউসে। সেখানে তখন স্বামী এবং সন্তানদের নিয়ে থাকছিলেন এলিজাবেথ। ব্রিটেনের মহারানী হওয়ার পর তার বাসস্থান হয় বাকিংহাম প্রাসাদ। তিনি সপরিবারে এই প্রাসাদে থাকতে শুরু করেন।
বাবাকে হারানোর দুঃখ প্রশমিত করতে মার্গারেট ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন পিটার টাউনসেন্ডের। রয়্যাল এয়ারফোর্সের এই কর্মকর্তার সঙ্গে তার পরিচয় অবশ্য আরও পুরনো। টাউনসেন্ডকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন ১৩ বছর বয়সে। বয়সে ১৬ বছরের বড় বিবাহিত এই সুদর্শনের প্রতি তার অনুরাগ সে সময় থেকেই।
টাউনসেন্ড বিবাহিত জেনেও মার্গারেটের অনুরাগে ভাটা পড়েনি। বরং, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও গভীর হয়েছে। ১৯৪৪ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন টাউনসেন্ড ছিলেন রাজা ষষ্ঠ জর্জের ‘ইক্যুয়ারি’। অর্থাৎ রাজার অন্যতম সহকারী। রাজার সব ঘোড়া রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও বর্তাত এই পদাধিকারীর ওপরেই।
রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পরে তার মেয়ে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময়েও ‘ইক্যুয়ারি’ পদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি, তিনি ছিলেন কুইন মাদার এলিজাবেথের (প্রথম) নতুন বাসভবন ক্ল্যারেন্স হাউসের কম্পট্রোলার-ও। প্রাচীন এই পদাধিকারীর দায়িত্ব ছিল, নির্দিষ্ট কোনও প্রাসাদের কোষাগার সামলে রাখা। পরে অবশ্য ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে পদটি বিলুপ্ত হয়।
মার্গারেট-টাউনসেন্ড সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ছিলই। ১৯৫২ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যু পরে টাউনসেন্ড তার প্রথম স্ত্রী রোজমেরিকে ডিভোর্স করলে সেই গুঞ্জন আরও তীব্র হয়। বিয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন দু’জনেই। আপত্তি ছিল না মার্গারেটের মা এবং বোনেরও। কিন্তু বাদ সাধল রক্ষণশীল চার্চ অব ইংল্যান্ড এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলও ছিলেন এই সম্পর্কের বিরুদ্ধে। শেষ অবধি একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন মার্গারেট এবং টাউনসেন্ড।
১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক তথা পরিচালক অ্যান্টনি আর্মস্ট্রং জোন্সের সঙ্গে এক পার্টিতে আলাপ হয় মার্গারেটের। সুন্দরী রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী হতে সময় নেননি জোন্স। কিন্তু মার্গারেট তার প্রস্তাবে সম্মতি দেননি প্রথমে। ১৯৬০ সালে টাউনসেন্ড তাকে জানান তিনি এক বেলজিয়ান তরুণীকে বিয়ে করতে চলেছেন এবং ওই তরুণী দেখতে নাকি মার্গারেটের মতোই। শোনা যায়, এ কথা শোনার পরই জোন্সের সঙ্গে নিজের বিয়ের কথা ঘোষণা করেন মার্গারেট।
চুনি এবং হিরে বসানো আংটি দিয়ে মার্গারেটকে প্রোপোজ করেন জোন্স। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তাদের বিয়ে হয় ১৯৬০ সালের ৬ মে। ব্রিটিশ রাজপরিবারে তাদের বিয়েই প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিল টেলিভিশনে। ব্রিটিশ রাজপরিবারে বিয়ের সূত্রে জোন্সের নতুন উপাধি হয় ‘আর্ল অব স্নোডন’। ১৯৬১ সালে ছেলে ডেভিড এবং ১৯৬৪-তে মেয়ে সারার জন্ম দেন মার্গারেট। বিয়ের পরে স্বামীর সূত্রে সমাজের বিভিন্ন মহলে তার অবাধ গতি তৈরি হয়। বহু ক্ষেত্রেই তিনি রাজপরিবারের বিধিনিষেধ ভেঙেছিলেন।
বিয়ের পরেও মার্গারেটের প্রেমিকা সত্ত্বা নষ্ট হয়নি। বিবাহিত মার্গারেটেরও একাধিক প্রণয়ী ছিল। শেষ অবধি ১৯৭৮ সালে ভেঙে যায় তার বিবাহিত জীবন। এরপর রাজকন্যার জীবন অনেকটা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। কৈশোর থেকেই তিনি ছিলেন ধূমপায়ী। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল সুরাসক্তি। সত্তরের দশকে তিনি স্নায়ুরোগের শিকার হন। এক দশক পরে ১৯৮৫ সালে বাদ দেওয়া হয় তার ফুসফুসের একাংশ।
১৯৯২ সালে দীর্ঘদিন পরে রোগ জর্জরিত মার্গারেটের সঙ্গে দেখা হয় টাউনসেন্ডের। মার্গারেট বলেছিলেন, সাদা চুল ছাড়া টাউনসেন্ডের চেহারার পরিবর্তন বিশেষ হয়নি। এর ৩ বছর পরে মারা যান টাউনসেন্ড। অন্যদিকে, আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন মার্গারেট। শেষ বছরগুলোয় ধূমপান ছেড়ে দিলেও তার সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল সুরার নেশা।
৭১ বছর বয়সে ২০০২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মারা যান প্রিন্সেস মার্গারেট। ৫০ বছর আগে ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ চলে গিয়েছিলেন তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার দিনই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তার আদরের মার্গটকে। সেই দিনটা ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি। মাঝে শুধু পাঁচ দশকের ব্যবধান।