শখের খেলনাটি যখন প্রাণঘাতী রোগের কারণ
কলকাতা টাইমস :
আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা৷ জার্মানির বায়রেউথ ও স্ট্রাউবিং শহরের কয়েকজন বিজ্ঞানী ঘরে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রীর ওপর পরীক্ষা চালান৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল পিভিসি জাতীয় প্লাস্টিকের মধ্যে মিশ্রিত বিষাক্ত থ্যালেট জাতীয় পদার্থের কারণে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি অনুসন্ধান করা৷ পরীক্ষার অংশ হিসেবে তারা দুটি শহরের জনমানবশূন্য অংশে ঘরবাড়ির অব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় মালামাল ডাম্প করেন৷ তারপর প্রায় ১০ বছর পরে ওই এলাকার মাটি, জল ও বাতাস পরীক্ষা করেন৷ ভয়ংকর খবর হচ্ছে, তারা সেখানকার মাটি, জল ও বাতাসে থ্যালেটের অস্তিত্ব পেয়েছেন৷ এমনকি বিজ্ঞানীরা ওই এলাকার জলজ প্রাণির টিস্যু পরীক্ষা করেও থ্যালেটের মতো যৌগ পেয়েছেন৷
আরও পড়ুন : গায়ে কাঁটা দেয়? আপনি স্পেশাল
২০১২ সালের দিকে সুইডেনের কয়েকজন বিজ্ঞানী পিভিসি ফ্লোরে খেলা করার পর কিছু শিশুর শরীর পরীক্ষা করে দেখেন, তাদের শরীরে থ্যালেটের অস্তিত্ব রয়েছে৷ এর মানে দাঁড়াচ্ছে থ্যালেট শুধু খাদ্যেই নয়, শ্বাস-প্রশ্বাস বা শরীরের রন্ধ্র দিয়েও প্রবেশ করতে পারে৷
দেশে থাকতে আমি অনেক ইলেক্ট্রিশিয়ানকে দেখেছি মুখের ভেতরে কামড়ে ধরে কপার তার থেকে রাবারের ইন্সুলেটর ছাড়াতে৷ ছোট শিশুদের প্লাস্টিক বা রাবারের খেলনা নিয়ে খেলার সময় দেখেছি, সেটা মুখের ভেতর নিয়ে চুষতে বা কামড়ে ধরতে৷
আমরা হয়তো বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা সচেতন নয়৷ কারণ আমরা প্লাস্টিক বা রাবারকে খুব বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছি৷ অথচ আমাদের অসচেতনতার ফলে আমাদের অজান্তেই এসব পদার্থ থেকে শরীরে মরণঘাতী রোগের বিস্তার লাভ করছে৷ আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না, আপনার অসুস্থতার জন্য এই প্লাস্টিক বা রাবারের তৈরি জিনিসগুলো দায়ী৷ কারণ এই ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ধীরে ধীরে আপনাকে ও আপনার শিশুর শরীরকে আক্রান্ত করে ফেলবে৷
ইলেকট্রিক তারের রাবার জাতীয় ইন্সুলেটর বা শিশুদের অধিকাংশ খেলনা তৈরিতে যে পদার্থটি ব্যবহার করা হয়, সেটি মূলত পিভিসি পলিমার৷ পলিমারের ভাষায় এটিকে বলা হয় সফট পিভিসি বা প্লাস্টিসাইজড পিভিসি৷ সফট পিভিসি তৈরির অন্যতম একটি উপকরণ হচ্ছে থ্যালেট জাতীয় যৌগ৷
রাসায়নিকভাবে বিভিন্ন থ্যালেটকে বলা হয় পলিমারের তুলনায় অনেক কম আণবিক ওজনসম্পন্ন যৌগ৷ রাসায়নিক যৌগের আকৃতি ও প্রকৃতিভেদে প্রায় ২৫ রকমের থ্যালেট হতে পারে৷ তবে সব থ্যালেটই কম-বেশি শরীর, পরিবেশ ও পানির জন্য বিপজ্জনক৷
ইলেকট্রিক তারের ইন্সুলেটর ও শিশুদের খেলনা ছাড়াও সফট পিভিসি দিয়ে ইলেকট্রিক টেপ, প্যাকেজিং টেপ, শিশুদের স্যান্ডেল, পিভিসি লেমিনেটেড ফ্লোর, হোস পাইপ, গামবুট, ব্লাড ব্যাগ, ফুড প্যাকেজ, গ্লু, পর্দা, পানির বোতল ও অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় থ্যালেট দিয়ে৷
বর্তমানে বিভিন্ন দেশে তুলনামূলকভাবে সব থেকে বেশি উৎপাদিত প্লাস্টিকটি হচ্ছে পিভিসি৷ তবে হতাশাজনক কথা হচ্ছে, বর্তমানে ৮০ শতাংশের বেশি পিভিসি তৈরিতে থ্যালেট বা থ্যালিক এসিডের মতো পদার্থ ব্যবহার করা হয়৷
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, থ্যালেটের কারনে হাঁপানি, রাইনাইটিসসহ ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে৷ এই থ্যালেট জাতীয় যৌগ প্রাণিদেহে হরমোনাল সমস্যা তৈরি করতে পারে। থ্যালেটকে বলা হয় অ্যান্ডোক্রাইন ডিসরাপটরসম্পন্ন রাসায়নিক যৌগ, যা কিনা ক্যান্সারযুক্ত টিউমার, জন্মগত ত্রুটি, শারীরিক বৃদ্ধিজনিত ত্রুটি সহ নারীদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়৷
রাবারের ইন্সুলেট বা শিশুদের খেলনাটি যে পিভিসি দিয়ে তৈরি হয়, সেটির আকার-আকৃতি বা প্রকৃতিভেদে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত থ্যালেট থাকতে পারে, যা কিনা পিভিসি পলিমারের প্রায় অর্ধেক৷ পিভিসি তৈরির সময় যে থ্যালেট ব্যবহার করা হয়, সেটি কখনোই রাসায়নিকভাবে পিভিসির সঙ্গে যুক্ত হয় না৷ শুধু বাহ্যিকভাবে সংযুক্ত থাকে৷ এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ৷ ফলে দৈনান্দিন কাজে ব্যবহারের ফলে পিভিসি থেকে ক্রমাগত থ্যালেট নিঃসৃত হতে থাকে৷ এই নিঃসৃত হয়ে যাওয়া থ্যালেটই পরিবেশে ছড়়িয়ে পড়়ে, অবশেষে যা চলে যায় আমাদের শরীরে৷
বিংশ শতাব্দী ধরেই বিভিন্ন দেশে বিষাক্ত থ্যালেটের ভয়াবহতা নিয়ে গবেষণা চলেছে৷ আমরা বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করি না বা অসচেতনতার অভাবে গুরুত্বও দিতে চাই না৷ আপনি হয়তো জানেনও না, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৭ ও ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের সব ধরনের খেলনা তৈরির উপকরণ থেকে থ্যালেটজাতীয় বিভিন্ন যৌগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে৷
ওই ঘোষণার পর থেকে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মোড় নিয়েছে অনেকটা ইউটার্ন নেওয়ার মতো৷ কারণ পিভিসি তৈরি উপকরণের জন্য থ্যালেটের বিকল্প পদার্থ পাওয়া খুবই বিরল৷ পিভিসি প্লাস্টিকের সুন্দর আকার দেওয়ার জন্য খুব সহজেই থ্যালেট ব্যবহার করা যায়, যা অন্য কিছু দিয়ে করতে গেলে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়৷ আবার তৈরিকৃত পণ্যটিও দীর্ঘমেয়াদি হয় না৷ এ জন্য সচেতনতা না থাকলে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সস্তায় ভালো পণ্য তৈরি করতে চাইবে-এটাই স্বাভাবিক৷ আর যদি এটা নিয়ে জনসচেতনতা না থাকে, তাহলে মানুষের নাকের ডগাতে বসেই এটা করা সম্ভব৷
বর্তমানে জার্মানিসহ সারা বিশ্বে পিভিসির জন্য থ্যালেটের বিকল্প প্লাস্টিসাইজার নিয়ে গবেষণা চলছে৷ এটাকে বলা হয়, বায়ো প্লাস্টিসাইজার৷ উদ্ভিজ্জতেল বা প্রাণিজ ফ্যাটকে আংশিক পরিবর্তন করে পিভিসিসহ অন্যান্য রাবার বা প্লাস্টিকের জন্য মানানসই করার কাজ চলছে৷ ইতোমধ্যে কিছু কিছু রাবার বা প্লাস্টিকের সাথে বায়ো প্লাস্টিসাইজার ব্যবহার করে সফলতা আসলেও তার ব্যবহার এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল৷
বিভিন্ন রাবার বা প্লাস্টিকের ওপর এখনো গবেষণা চলছে৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে একটি ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, সেখান কার প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দিই৷ কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারি প্রচারণায় থাকে এই পর্যন্ত যে অপচনশীল প্লাস্টিক দ্বারা পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে, নালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। অথচ এই প্লাস্টিক থেকে ক্রমাগত থ্যালেট জাতীয় যৌগ সরাসরি বা ডিকম্পোজ হয়ে প্লাস্টিক থেকে নিঃসৃত হয়ে যে পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে, ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের কোনো উদ্বেগ নেই৷
জনসাধারণের উচিত থ্যালেটমুক্ত প্লাস্টিকের ওপর জোর প্রচারণা চালানো, যাতে করে শহর থেকে গ্রামে থ্যালেটের ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাই অবগত হয়৷ এ ছাড়া বাংলাদেশে উৎপাদিত প্লাস্টিকে যাতে থ্যালেট না ব্যবহৃত হয়, সরকারের উচিত সেদিকেও নজর জোরদার করা৷ সামগ্রিকভাবে বলতে হয়, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার জন্য দরকার আমাদের সবার সচেতনতা৷