কার যে কখন কী হয়?!
ভাবুক বাবুর ভাবনা
ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতেই দেখি আমার স্কুলের বন্ধু ভাস্কর বসে আছে। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল- “তুই আর ডাক্তার পেলি না, এই বদমায়েশটার কাছে এসেছিস”! আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম- বলিস কী রে, এত বড় ডাক্তারের সম্পর্কে এত বড় কথা বললি! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ভাস্কর পাশের রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে বলল- সাধে কী আর বলছি রে? বহু ঝাড় খেয়েই কথাটা বললাম। শালা ডাক্তার আমার একটা কথাও বিশ্বাস করে না। আমার কৌতূহল বেড়েই চলেছে। না থাকতে পেরে বললাম- কেন, তোর কী হয়েছে যে ডাক্তার বিশ্বাস করছে না? ভাস্কর ভয়ঙ্কর ক্ষেপে গিয়ে বলল- আমি প্রথম দিন এসে বললাম, ডাক্তারবাবু, আমার মাথাটা ঘাড়ের উপরে লাট্টুর মত ঘুরছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন? ডাক্তার কি বলল জানিস? বলল, পরের দিন একটা হাতুড়ি আর রেঞ্চ নিয়ে আসিস , ভাল করে সব টাইট দিয়ে দেব। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে গেল। আরে, আমারও তো বেশ কয়েকদিন ধরে মাথা ঢনঢন করছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখে নিলাম । নাঃ, এখনও মাথা লাট্টুর মত ঘুরছে না বটে, তবে ঘুরতে কতক্ষণ? ভাস্কর আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে বলল- দেখছিস ট্রেনটা কেমন পাক খেতে খেতে আমার দিকেই তেড়ে আসছে! যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে আমার। কোনক্রমে ভাস্করের হাত ছাড়িয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম।
এর পর তিন বছর কেটে গেছে। ইতিমধ্যে আমি সাংবাদিক হয়েছি। যদিও আমার তৎকালীন সম্পাদক মশাই তাঁর জীবৎকালে সে কথা কোনওদিন মানেননি। না মানার যথেষ্ট কারণ ছিল। একবার তিনি আমায় বেশ কিছু খ্যাতনামা পাগলের লিস্ট বানাতে বলেছিলেন। আমি যথেষ্ট সততা ও সাংবাদিকতার আদর্শ বজায় রেখে তালিকার প্রথমেই ওঁর নামটা লিখেছিলাম। তালিকাটা তাঁকে দেখাতেই তিনি হো হো করে হেসে বলেছিলেন- তোমার সৎ সাহস দেখে তোমার মাইনে দ্বিগুণ করে দিলাম, সঙ্গে এই নাও তোমার ডিমোশন লেটার। ভারতবর্ষের সমস্ত পাগলা গারদ ঘুরে পাগলদের কান্ডকারখানা আমাকে জানাবে। প্রথমেই তোমাকে যেতে হবে মানকুন্ডু। মানকুন্ডু পাগলা গারদ একসময় দুর্ধর্ষ ছিল। স্বাধীনতার আগে বাংলার বিপ্লবীদের নাকি পাগল বানিয়ে ওখানে পোরা হত যাতে ফাঁসির আসামী হাসতে হাসতে মোম লাগানো দড়ি গলায় ঝোলানোর জন্য আকুপাকু করে। ফাঁসির আগে এ ব্যাপারে তাদের বিশেষ ট্রেনিংও দেওয়া হত। সে যাক। আমি একদিন হাজির হলাম সেখানে। কর্তৃপক্ষকে নিজের পরিচয় দিলাম। আমার দুঃখের কথা শুনে উনি প্রায় কাঁদোকাঁদো স্বরে বললেন- আহা রে! বাছা, তোমার সম্পাদক কি মানুষ না কষাই? তুমি ভিতরে ঢুকলেই তো পাগলগুলো তোমার জামাকাপড় খুলে তোমাকে দিগম্বর বানিয়ে ছাড়বে। আমি শকুন্তলা কালিবাড়ির বলি প্রদত্ত পাঁঠার মত বললাম- দে মা আমায় পাগল করে। আমি ভিতরে ঢুকতেই এক পাল পাগল ছুটে এল আমার দিকে। মিষ্টি এবং বীভৎস হাসি হেসে ওরা আমার জামা কাপড় খুলতে খুলতে কাতুকুতু দিতে থাকল। কাতুকুতুর ফলে হাসতে হাসতে আমি যখন প্রায় আহ্লাদে আটখানা তখনই শুনলাম এক ভয়াল নির্দেশ- ছেড়ে দে ওকে। ও আমার বন্ধু। আমি কোনক্রমে তাকিয়ে দেখলাম ভাস্কর দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাবভাব দেখে বুঝলাম , পাগলামিতে ও নিশ্চয়ই ডবল এম.এ করেছে। বাকীরা বেশ সমীহ করে ওকে। ভাস্কর আমাকে ভূমিশয্যা থেকে তুলে সস্নেহে গায়ের ধুলো ঝেড়ে বলল- তোকে যে একদিন আমাদের মধ্যে পাবো তা আমি আগেই জানতাম। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- কার যে কখন কী হয়?
ব্যাস, সেই মুহূর্তে আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হল। আমি ত্রিকালজ্ঞ হলাম। যত বয়স বাড়ছে ততই বুঝতে পারছি- কি মর্মান্তিক এই সত্য- কার যে কখন কী হয়!
মহাসত্য, অভ্রান্ত সত্য। মহারাজ হরিশচন্দ্র হয়ে গেল ভিখারি হরিশ। আবার ভিখারি রাঘব হয়ে উঠল “জয় শ্রী রাম”। মহাশক্তিশালী বীর হনুমান স্বর্ণলংকা পোড়াতে গিয়ে নিজেই নিজের মুখ পুড়িয়ে এল। তোর কি লাভ হল রে ব্যাটা হনু? সোনার একটা সুতোও কি তুই পেয়েছিস মুখপোড়া? রাম বনবাসে যাওয়ার পর কৈকেয়ী কেন নিজের হাতে মোষ বলি দিল?
বারোমাস? রাবণেরও বলিহারি বটে! সত্তর বছর বয়সে সীতাকে হরণ করতে গেলি? কাণ্ড বটে নারদেরও! গনেশের মুন্ডু কাটা পড়েছে ঠিক আছে, কিন্তু তোর তো বিবেচনা আছে না কি? বাঘ ভাল্লুক কিছুই পেলিনা, একটা হাতির মুন্ডু বসিয়ে দিলি! কী আক্কেল রে তোর? মহাভারত তো একটা সার্কাস। মাত্র সাতটা গ্রামের জন্য বৃদ্ধ বয়সে যুদ্ধ যুদ্ধ মশকরা করল অর্জুন, কর্ণ, দুর্যোধন, দুঃশাসন? হিসেব করলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় অর্জুনের বয়স ষাট, কর্ণ পঁয়ষট্টি, দুর্যোধন সত্তর আর যুধিষ্ঠির আশি। আর ভীষ্ম তো ঘাটের মড়া, করোনাতেও মরে না। সে সময় “জয় শ্রী রাম” তো ছিল। তিনিও এমন কী করলেন যে তার জন্য তাঁকে “হায় রাম”, “ছিঃ রাম”, “রাম ছাগল”, “রাম বলদ” শুনতে হয়েছিল? পুরাণে উহ্য থাকলেও আজও একই ঘটনা ঘটে চলেছে। এ কেমন কথা যে শুভেন্দু অধিকারীদের পুরো গুষ্টি বাবুল সুপ্রিয়র মধুর গানের গলা টিপে ধরবে? গো বংশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিলীপ ঘোষকে মোষের বাচ্চা বানিয়ে দেবে? শোনা যাচ্ছে পিসি ভাইপো নাকি প্রাইভেট লিমিটেড রাজনৈতিক দল গড়বেন। ভালই হবে। এরপর আদানি, আম্বানিরা ভোটে দাঁড়াবে। বৌদ্ধযুগ আবার ফিরে আসবে। আসতে চলেছে বৈশ্য সভ্যতা, গৌতম বুদ্ধর প্রিয় সম্প্রদায়।
মেদিনীপুর চিরকাল যাত্রাপালার জন্য বিখ্যাত। যাত্রার অধিকারীরাই পালা ধরেন, পালা ফেলেন। সে হিসেবে শিশির শুভেন্দু প্রকৃত অধিকারীর কাজ করেছেন। কিন্তু “কার যে কখন কী হয়” সিনড্রোমে আক্রান্ত গোপুত্র দিলীপের কি হবে? ঘাস ছিড়বে? কিংবা বাবুল সুপ্রিয় কি “কহো না পেয়ার হ্যায়” বলে অমিত শা’র গলা জড়িয়ে গালে হামি খাবে? কিছুই বলা যাচ্ছে না। গাছে মুকুল ধরবে না? একবার “কার যে কখন কী হয়” হয়েছিল শ্রীযুক্ত “কারাত”এর। নইলে মনমোহনের কংগ্রেস সরকার ছেড়ে সেই তো নাম খোয়ালি, আগে কেন এঁটো হলি অবস্থা হল? ধীরে ধীরে অধীরের শূন্য কোলেই বসতে হল? শুধু তাই নয়, একজন পীরজাদাকে মাথায় চড়িয়েছে। সিপিএম ভগবানকেও ভয় পায় না, কিন্তু খোদার ভয়ে ধুতিতেই করা শুরু করেছে এগারো সাল থেকে, তাই ফুরফুরে মেজাজে ফুরফুরায় কাপড় খুলছে।
“কার যে কখন কী হয়” রোগে সব চাইতে বেশি আক্রান্ত সংবাদ মাধ্যম। সুমনের কথাই ধরুন। তার সঙ্গে ঘন্টা খানেক কাটানোর চাইতে উকুন বাছাও ভাল কাজ। কে তোকে বলেছিল বাপ আগ বাড়িয়ে কে কটা সিট পাবে তা জানানোর? সুমন যে অংকে কাঁচা তা আগের নির্বাচনেই প্রমানিত। খেলা এখনও অনেক বাকি। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, “কার যে কখন কী হয়” রোগ তত বেশি ছড়িয়ে পড়বে। ভোটারদের যদি “কার যে কখন কী হয়” রোগে ধরে তাহলে কিন্তু বেশ বিপদ। বাংলার মসনদ ত্রিফলা আলোর মত হয়ে যেতে পারে, তাই আগেই ভেবে নিন, দু মাস পরে যেন “কার যে কখন কী হয়” রোগ না ধরে।