নাগা সন্ন্যাসীদের এই রহস্য জানলে চমকে উঠবেন
কলকাতা টাইমস :
সংসার জীবন থেকে অনেক দূরে, ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন এবং শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই শরীর থাকে উদোম- এমন হুলিয়া বলে দেয় যে এরা নাগা সন্ন্যাসী বা নাগা সাধু। উপমহাদেশে সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন তীর্থকেন্দ্রের আশপাশে বিশেষ করে কুম্ভ মেলায় প্রায়ই তাদের দেখা মেলে। চুলে জটাধারী, গায়ে ছাইভষ্ম মাখা এই সন্ন্যাসীরা লোকালয়ে কমই আসে। কেউ কেউ এদের যোদ্ধা সন্ন্যাসী বলেন।
অনেকেই মনে করেন, তাদের কামবাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যম অর্থাৎ লিঙ্গ যেহেতু অকেজো করে দেওয়া হয় সেহেতু তাদের শারীরিক শক্তি প্রবল হয়। তাই নাগা সন্ন্যাসীরা বেশ শক্তসমর্থ হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, নাগা সন্ন্যাসীদের মাঝে নারীও (সন্ন্যাসিনী) আছে যা অনেকে হয়তো জানেন না। তবে তারা পুরো নগ্ন থাকে না। একখণ্ড কাপড় দিয়ে শরীর ঢেকে রাখে এবং এমনকি গঙ্গাস্নানের সময়েও বস্ত্র ত্যাগ করে না।
জীবন এবং মৃত্যুর বিদ্যা হচ্ছে পরাবিদ্যা, ব্রহ্মজ্ঞান। ব্রহ্মজ্ঞান বিনা (জগৎ বিষয়ে) প্রশ্নের সমাধান নেই। কোথা থেকে শুরু আর কোথায়ই বা গমন আর এ বিষয়ে সফলতার আনন্দটাই বা কী! ব্রহ্মজ্ঞান ছাড়া জীবনের আনন্দটাই বা কি… যাকে খুঁজছেন আপনি সে-ই!
নাগা সাধু দিগম্বর অখিলেশপুরী নাগা সাধুদের জীবনধারা সম্পর্কে বলেন, আমাদের লিঙ্গ অকেজো করে দেওয়া হয়। আমাদের কোনো কামনা-বাসনা থাকে না। যারা যৌন কামনার প্রবল বেগকে সামলে নিতে পারে তারাই নাগা। কাম, ক্রোধ, লোভ… সেই সিদ্ধি লাভ করে যে যৌনবাসনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়।
নাগা অর্থ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃত সত্য সন্ধান করে যে। এ ধরনের ব্যক্তিদের সাংসারিক জীবন থেকে দূরে থাকতে হয়। তাদেরকে ত্যাগের প্রতীক বলে মান্য করে ভক্তরা। তারা সাধনা করে আর কঠিন ব্রত পাল করে। কুম্ভমেলার সময়ে নাগা সন্ন্যাসীদের ব্যাপকহারে দেখা মেলে।
তবে দেখা যায়, নাগা সাধুরা বিভিন্ন দল-গোত্রে বিভক্ত। প্রায়ই তাদের মাঝে বিবাদ বিসম্বাদ লেগে যায়। প্রবল শারীরিক শক্তির প্রয়োগ দেখা যায় অনেক সময় একে অপরের ওপর।
আবার সংসার ধর্মের বাইরে জীবন যাপন হলেও তাদের একেকটা আখড়ায় নিয়ম-কানুন রয়েছে, রয়েছে সাধারণ মানুষের মতো সামাজিক ব্যবস্থাপনা। প্রতি চার বছর অন্তর প্রধান বা শ্রীমোহন্ত নির্বাচন হয়, নির্বাচন হয় কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার), কোতোয়াল, পূজারি প্রমুখ পদধারী। পূজারির কাজ নিয়মমতো পূজা করা, আখড়াগুলোর বিশাল সম্পদসূত্রে প্রাপ্ত অর্থভাণ্ডারের হিসাব রাখেন কোষাধ্যক্ষ, আর কোতোয়াল আশ্রমের শান্তিরক্ষা তথা সাধুদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদ মেটানোর কাজ করে।
সনাতনীদের পবিত্র তীর্থ হরিদ্বারের এক নাগা সাধু বলেন, নাগা সাধু হচ্ছে ধর্মের সৈনিক।
এ প্রসঙ্গে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগ ও আধুনিক ইতিহাস বিভাগের প্রধান প্রফেসর যোগেশ্বর তিওয়ারি বলেন, ভারতে যখন বকধার্মিকদের দৌরাত্ম্য প্রচণ্ড রূপ নেয় তখন তাকে রুখতে গুরু শংকরাচার্য একটি খারু গঠন করেন। ওই সঙ্ঘের মাধ্যমেই নাগাদের পত্তন হয়। শাস্ত্রজ্ঞান ও অস্ত্রজ্ঞান- উভয় বিষয়েই এই নাগারা বিজ্ঞ ছিল। এই দুয়ের প্রয়োগে তারা তখন সনাতন ধর্মের ওপরে যে বিপত্তি নেমে এসেছিল তার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তী মুসলিম শাসনামলেও এই সাধুরা স্বধর্ম রক্ষায় তৎপর ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নাগা সন্ন্যাসীদের একটি গ্রুপ ইংরেজ আমলে লোকজনকে টাকা ধার দিতেন, নির্দিষ্ট সময় পর তা তুলে নিয়ে যেতেন ফায়দাসহ। এ নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে তাদের বিবাদ-লড়াই হতো প্রায়ই। নাগা সন্ন্যাসীরা কেউ কেউ রাজা-জমিদারদের পক্ষে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে লড়াইও করতো।
ব্রিটিশ আমলে মুসলিম ফকিরদের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের কোনো কোনো পক্ষ ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে বলেও জানা যায়। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, এই সন্ন্যাসীগণ ছিলেন বেদান্তীয় হিন্দু যোগী এবং একদণ্ডী সন্ন্যাসবাদের গিরি ও পুরী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রসঙ্গত, বাংলায় ইংরেজ কোম্পানি শাসনের তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৭৬০ সালের জুনে বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চল থেকে শুরু হয়েছিলো ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ফকির মজনু শাহ্ এই বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ ছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে নাটোরের জমিদার দেবী চৌধুরাণীর সেনাপতি সন্ন্যাসব্রতধারী ভবানী পাঠক এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন, অনুপ্রাণিত করেন। ভোজপুরী ব্রাহ্মণ ভবানী পাঠক তখন মজনু শাহর সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
ইতিহাসবিদ ড. সিরাজুল ইসলালের লেখায় জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ‘নাগা’ ও ‘গিরি’ সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। অযোধ্যার নবাবের সৈন্য বাহিনীতে ‘গোসাই’ বাহিনী গঠিত হয় মূলতঃ ওই সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে। ইংরেজ কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নবাব মীর কাশিম ফকির-সন্ন্যাসীদের সাহায্য নিয়েছিলেন।