May 25, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

বদনের বউ (গল্প)

[kodex_post_like_buttons]

অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় 

সেকালে একদিন, পরাশর যমুনা পুলিনে উপস্থিত হয়ে দাসনন্দিনীকে দেখামাত্র মদনবেদনায় অতিমাত্রায় ব্যাকুল হলেন। বললেন’তুমি আমার মনোভিলাষ পূর্ণ কর। ‘দাসকন্যা বললেন ‘দেখুন, নদীর দুইতীরে ঋষিরা পারাপারের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, প্রকাশ্যে কীভাবে তা সম্ভব,যা আপনি চান?’ তার কথা শুনে পরাশর নৌকোঘিরে ঘোর কুয়াশা সৃষ্টি করলেন।যমুনার তট দৃষ্টিগোচর রইলনা এবং ঋষি জেলের মেয়েতে উপগত হলেন। কন্যা গর্ভবতী হয়ে যমুনা নদীর দ্বীপে এক পুত্রের জন্ম দিলেন। পরাশর জেলেকন্যার যে কুমারীত্ব হরণ করলেন, সেই কুমারীভাবের সাথে তার গায়ের মত্সগন্ধকে পদ্মগন্ধ করে মেয়ের বাবার কাছে মেয়েকে ফিরিয়ে দিলেন। এবং ছেলে দ্বৈপায়নকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরতে চাইলেন।পুত্র দ্বৈপায়ন তার কুমারী মায়ের কাছে কথা দিলেন যেকোন প্রয়োজনে তিনি তাকে ডাকলেই  হাজির হবেন।
মহাভারতের ভ্রূণ হাতে দ্বৈপায়ন ও তার বাবা পরাশর নির্বিঘ্নে নিস্ক্রান্ত হলেন।
আসন্ন মহাভারতের অপেক্ষায় রইল ভূ-ভারত! 
একালে একদিন,কাজ থেকে ফিরে বদন, বদনের বউ আর ওদের তিন বছরের মেয়ে বকুল, তিনজন মিলে গঙ্গায় নৌকো চেপে চলেছিল সোদপুর। বদনের বউর দিদির বাড়ি। ভরভরন্ত গঙ্গা।
একে বর্ষাকাল, তাতে ভরা কোটাল। স্রোতে টান খুব।খুব দুলছে নৌকো।সম্ভবত এই ঘাট থেকে সোদপুরের দিকের শেষ খেয়া এটা।কি বড়জোর  এটাই ওপার  হয়েএসে ফিরবে।
নৌকোয় লোকজন তেমন ছিলনা। ওদের নিয়ে মেরেকেটে জনা দশেক যাত্রী হবে।লোকের ভার ছিল না বলে নৌকা দুলছিল খুব। বদন এমনিতেই একটু ভীতু প্রকিতির লোক। নিরীহ গোবেচারা ধরনের। গৌরাঙ্গ মিস্ত্রীর হেল্পার হিসেবে কাজ করে ও।রঙের কাজে গৌরাঙ্গর নাম আছে। তাই বদনের সারাবছরের কাজের অভাব নেই।ওর যেটার অভাব আছে সে হল বুদ্ধির। বদনের বউ হল তার বুদ্ধির ভাণ্ডার।বউর ওপর অগাধ বিশ্বাস  থাকা বদন তার বউর কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনে চলে।যেমন নৌকোতে উঠেই বদনের বউ ছইএর তলায় ঢুকে, বদনকে হাতের ঝোলাটা নিয়ে নৌকোর মাথার কাছে বসতে বলল নাবতে সুবিধা হবে বলে।
 বদন, ছোকরা মাঝির সামনেটায় বসে পড়ল।বদনের বউ মেয়েকে নিয়ে ছই এর তলায় বসতে যেয়ে ভক্ করে নাকে পেল সেই চেনা গন্ধ। বদন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাসে এক দু-দিন এইসব ছাইপাশ খেয়েই ঘরে ফেরে এখনো। বদনের বউ রাগকরে দেখেছে,অভিমান করে দেখেছে, শুধরোলেও একদম ছাড়তে পারেনি বদন।তবে দড়িছুট হয়নি।বদনের বউ  কড়া শাসনে রেখেছে। 
বদনের বউ নৌকোর ছইএরতলায় ঢুকে দেখল,  ভেতরে চার পাঁচজন মানুষ প্লাস্টিক বোতল নিয়ে গজলাচ্ছে। বদনের বউ- মেয়েকে দেখে ওরা গলা নাবিয়ে নিলেও,সাবধানে বসতে যেয়ে বদনের বউ বে-জায়গায় একটা ধাক্কা খেয়ে সিটিয়ে গেল। হাসির ছররা উঠল ওদের মধ্যে।
বদন আকাশের দিকে চেয়েছিল বৃষ্টির সম্ভাবনা মাপতে। ওঃ, দেখ শালা, ব্লাক জাপানের মত আকাশের রঙ ধরিয়েছে।ভগবানই পারে এমন বেআক্কেলের মত রঙ্ লাগাতে। 
বদনের বউ চেঁচিয়ে উঠতে, চমক ভেঙে বদন দৌড়ে হেচড়ে পেচড়ে ছইর কাছে যেয়ে দেখে মেয়েটা তারস্বরে চেল্লাচ্ছে, গোটা দুই লোক ওর বউর গা ছুঁয়ে দিল্লাগি মারছে। বদন গলাছিঁড়ে চিল্লে ওঠে।“এই, কি হচ্ছে কি”?
গোটা নৌকোটা কেঁপে ওঠে বদনের চিৎকারে।স্রোতের টানে নৌকোটা ছুটছে জোরে।তটভূমির আলো মানুষ ঝাপসা হচ্ছে ক্রমে।হাওয়ার ঠেলায়,জলের টানে ভেতরের মানুষগুলোর ধ্বস্তাধস্তিতে নৌকো টলছে পাগলের মত।বদন উন্মাদেরমত লড়েযাচ্ছে প্রমত্ত মানুষগুলোর সাথে। প্রাণপণে জাপ্টে ধরে আছে তার স্ত্রী ও মেয়ের হাত। সাতসাতটা অমানুষের সাথে টলমল নৌকোয় অভিমন্যুরমত লড়ছে বদন।আর লড়তে লড়তে ভাবছে কাগজে টিভিতে ও পড়েছে দেখেছে,ট্রেন বাস ট্যাক্সি বিমানে,হোটেল বাড়ি স্কুল কলেজ,বন-জঙ্গল মাঠ ঘাট,শহরে গ্রামে, স্থলে অন্তরীক্ষে,অটো টোটো সর্বত্র এই লাঞ্ছনার ঘটনার কথা, ঘটানোর কথা। 
ও দেখেছে পড়েছে। কিন্তু জলে নৌকোর মধ্যে, তাও আবার গঙ্গার বুকে,এ তার শোনা জানা নেই। সেই সব ভয়ংকর শোনা জানা ঘটনাগুলো যে তার জীবনেও ঘটতে পারে এ যেন বিশ্বাস হতে চায়না।
 অল্পবুদ্ধি বদনের শরীর মন ফেটে পড়তে চায় সর্বস্ব পণ করে। হিংস্র উন্মত্ততায় রাতের আকাশ ভারী হয়ে ওঠে আর্তচিত্কারে।বদন প্রার্থনা করে ওর দশ আঙ্গুলে বাঘের নোখ গজাক।শরীরটা ফেটেযাক বোমের মত।
বদনের বউ হঠাৎই ওর মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে ঝাপিয়ে পড়ে ভরা গঙ্গায়। বদন কঁকিয়ে ওঠে।
পবিত্র কথিত গঙ্গার জলে ঝাপিয়ে নিজের পবিত্রতা রক্ষা করেও বদনের বউর প্রাণহীন শরীরে ছাপ পড়বে অভাবে  আত্মহত্যা করেছে বলে,নয়ত পারিবারিক গোলযোগ বলে। অবশ্য যদি লাশ পাওয়া যায়! 
কলির মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেবরা সম্পাদকীয় স্তম্ভে, কলামে লিখবে কত উত্তেজক গল্প। দূরদর্শনের টেবিলে আলোচনায় বসবে। মোমবাতি নিয়ে মিছিল করবে। গঙ্গায় তলিয়ে যাবে সব সত্য, বদনের বউর মত।
আজকের পরাশররা যে নরীত্ব হরণের পর কুমারী করে ঘরে ফেরত দিতে পারে না রে মা!
পারে দেহকে বডি বানাতে! লাশ! ভীত সন্ত্রস্ত লাশ! দুর্গন্ধময়ী! 
দেখে যাও মত্সগন্ধা তুমি যা পারনি বদনের বউ তা পেরেছে।
তাই ,ও বা ওরা, বদনের বউ হয়েই থেকে যাবে চিরদিন।সত্যবতী হবেনা কোন কালে।

Related Posts

Leave a Reply