একটি বেনারসি বুনতে কজন আর কতদিন লাগে জানলে চোখ কপালে উঠবে
[kodex_post_like_buttons]
কলকাতা টাইমস :
বিয়ে-বাঙালি-বেনারসি যেন এক সুতোয় গাঁথা। বাঙালি বিয়ে মানেই কনের পরনে লাল টুকটুকে বেনারসি। সঙ্গে সোনার গয়না। অনেককাল আগে থেকেই বিয়ের সঙ্গে বেনারসি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। চওড়া পাড়ের সোনালি বা রূপালি সুতোর কাজ, সবসময় মুগ্ধ করেছে সবাইকে। বিয়ের সময় বেশিরভাগ কনের প্রথম পছন্দ বেনারসি। শুধু, লাল নয়, বিভিন্ন রঙের বেনারসি পরতে দেখা যায় কনেকে।
তবে জানেন কি? এই বেনারসির জন্ম কোথায়, কীভাবে মিশে গেল বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে। মুঘল সাম্রাজ্যে ভারতে প্রবর্তিত হয়েছিল এই শাড়ি। মূলত ভারতের বেনারশ শহরের নামেই এই শাড়ির নামকরণ করা হয় বেনারসি। বিশেষ এক তাঁতে তৈরি হত এই শাড়ি। সেসময় বেনারশ শহরে বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম তাঁতি।
একটি শাড়ির বুনতে সময় লাগে ১৫ দিন থেকে এক মাস এবং কখনো কখনো ছয় মাসও লেগে যায় একেকটি শাড়ি তৈরি করতে। বেনারসে এই শাড়ির দুটি বয়ন কৌশল রয়েছে-কাধুয়া এবং ফেকুয়ান। কাধুয়ান একটি বিশুদ্ধ তাঁত যা শুধু বারাণসী অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। এই জটিল ডিজাইনগুলো শুধু হাতে চালিত তাঁতেই তৈরি হয়। এজন্য বেশ সময়সাপেক্ষ এই শাড়ি তৈরি করা। একেকটি কদুয়ান বেনারসি শাড়ি বুনতে তিনজন তাঁতির সময় লাগে ৩-৪ মাস। যে সময়ের মধ্যে একটি ফেকুয়ান শাড়ি একজন তাঁতি বুনতে পারেন।
বেনারসি শাড়ির জন্য চারটি প্রধান কাপড় ব্যবহার করা হয়, খাঁটি সিল্ক (কাতান সিল্ক), অরগ্যানজা, জর্জেট এবং শাত্তির। এর মধ্যে বিশুদ্ধ সিল্কের বেনারসিও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। জমকালো এসব কাপড়ের ওপর নানা ধরনের নকশা করা হয়। প্রধান বেনারসি নকশাগুলো হলো জংলা, তানচোই, ভাস্কট, কাটওয়ার্ক, টিস্যু এবং বুটিদার।
বুটি বা ফ্লোরাল মোটিফের সঙ্গে কাতান সিল্কের বেনারসি শাড়িও বেশ বিখ্যাত। এগুলো সাধারণত জরি সুতো ছাড়াই তৈরি করা হয় নরম এবং ভারী সিল্ক দিয়ে। বুটি, পাতা, ফুলের মোটিফে রেশম, জরি বা মিনাকারি ডিজাইনে তৈরি করা হয় বেনারসিরও চল রয়েছে।
বেনারসি আছে কয়েক প্রকারের। তাঞ্চই, কারুয়া, জামদানী, বুটিদার, জারদৌসিসহ বিভিন্ন নামে আছে জামদানি। তাঞ্চই বেনারসিতে সূক্ষ্মভাবে বোনা সুতোর হাল্কা কাজ করা থাকে। বলা হয় এই শাড়ির বুনন পদ্ধতি মূলত চীন থেকে এসেছে। সেই পদ্ধতি বেশ জটিল। প্রায় পাঁচ রকমের রং ব্যবহার করা হয় বুননে। চীনের তিন ভাই সুরাতে এসে তাঁতিদের এই বুনন পদ্ধতি শেখান। পরবর্তীকালে তা বেনারসে আসে। তিন ভাইয়ের নামের শেষে চই শব্দটি ছিল। সেই অনুসারেই তিন ও চই শব্দ মিলিয়ে এই শাড়ির নামকরণ তাঞ্চই।\কড়া হুয়া শব্দদ্বয় থেকে কারুয়া বেনারসির নামকরণ। এই শব্দদ্বয়ের অর্থ হচ্ছে এমব্রয়ডারি করা। সাধারণত বেশ উজ্জ্বল হয় এই ধরনের বেনারসি। এই শাড়ি বুনতে হয় সনাতনী তাঁতে। এমব্রয়ডারি করা এক-একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগে প্রায় দুই মাস।
জামদানী বেনারসি হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের মসলিন এবং দুই রকমের সুতো দিয়ে শাড়ি বোনা হয়। এই বেনারসিতে সিল্কের কাপড় থাকে। সঙ্গে মেশানো থাকে সুতির ব্রোকেড। বুটিদার বেনারসিকে গঙ্গা-যমুনা বেনারসি নামেও এই শাড়িকে ডাকা হয় অনেক সময়ে। শাড়িতে রুপোলি ও সোনালি দুই ধরনের শেড দেখা যায়। ঘন নীলের উপর সোনা ও রুপোর জরির সুতোর কাজ। এর মধ্যে থাকে সিল্ক। আর থাকে বিভিন্ন ধরনের বুটির ব্যবহার। রেশম বুটি, আশরফি বুটি, লতিফা বুটি, ঝুমর বুটি ইত্যাদি।
বিশেষ ধরনের কারুকার্য করা বেনারসিকে বলা হয় জারদৌসি বেনারসি। বুলিয়ন সুতো, ফ্রেঞ্চ ওয়্যার বা মেটালিক স্প্রিং থ্রেড দিয়ে ঘন করে এমব্রয়ডারি করা হয়। এই ধাতব সুতো চকচকে ও প্যাঁচানো। যেহেতু ধাতব সুতো তাই এই শাড়িতে সোনালি ও রূপালি এই দুই ধরনের শেড দেখা যায়।
বেনারসি হ্যান্ডলুম টেক্সটাইলগুলো ভারতের তাঁত শিল্পের বৃহত্তম কুটির শিল্পগুলোর মধ্যে একটি। এটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বারাণসীর আশেপাশের বেশ কয়েকটি শহর, শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তরপ্রদেশের বারাণসী, মির্জাপুর, চান্দৌলি, ভাদোহি, জৌনপুর এবং আজমগড় জেলাগুলো শাড়ির উৎপাদন কেন্দ্র।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতের বেনারস থেকে প্রায় ৩০০ মুসলিম তাঁতী পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তারা মূলত ঢাকার মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বসতি স্থাপন করে। তারা তাদের আদিপেশা এই তাঁত শিল্পের কাজ এদেশে এসেও অব্যাহত রাখে। নান্দনিক ডিজাইন, উন্নত রুচি এবং নিপুণ বুননের কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্থানীয়রাও এ কাজে যোগদান করলে তা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। ক্রমান্বয়ে তাঁতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কারখানাগুলো পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে মিরপুরে নিয়ে আসা হয়।