May 19, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

আসলে ‘কথা’, তারই আবার ‘ইচ্ছে’

[kodex_post_like_buttons]
অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
চ্ছে হল ফনধর সাপের ফনা। ইচ্ছের না আছে স্বচ্ছ দেখার চোখ, না আছে ঘ্রাণনেবার নাক, না আছে হেটে চলার পা,জাপ্টে ধরার হাত!ইচ্ছের খালি আছে বুক।  বুক দিয়ে অনুভব করে।বুকে বুক লাগিয়ে জাপ্টেধরে। ইচ্ছে প্রায় অন্ধ।বুকের গভীর গোপন অন্ধকার থেকে হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বুকে বাসাবেধে বসে। 
ইচ্ছে ফনা ধরে,গোটায়।সে হঠাৎ আসে, হঠাৎ যায়। ইচ্ছের ভরসা রকমারিতে। বুড়োর খোকা হবার ইচ্ছে, যে হাটে তার ওড়ার ইচ্ছে।সারাজীবন মুখবুজে থেকে হঠাৎ ইচ্ছে গজায়  মুখর হবার। বাটিভরা জল দেখে সমুদ্র পার হতে ইচ্ছেকরে। যে যেখানে থাকে,যে ভাবেই থাকে,ইচ্ছেগুলো তাকে অন্যকোথাও অন্যকোনভাবে থাকতে সাঁকোধরে নেড়ে দেয়। ইচ্ছের গায়ে রামধনু রঙ।ইচ্ছের মতি স্থির নেই।ইচ্ছে নারী পুরুষ ধনী গরীব মানে না, ছোট বড় সাদা কালো, ব্রাহ্মণ সিডিউলকাস্ট, মন্ত্রী সান্ত্রী মানে না। কেন যে ইচ্ছে হয়!
ফুটবল খেলা ছেড়ে একটা বাচ্চার কেন যে ব্লুহোয়েল খেলার ইচ্ছে গজায়। কেন যে একজন ফেরিওয়ালার বুকে নিজের রোজগার থেকে একটা হাসপাতাল তৈরি  করার ইচ্ছে জন্ম নেয়!হঠাত্ সব ছেড়ে ছুড়ে হারিয়ে যাবার ইচ্ছের নাড়া খেয়ে উধাও হয় কেউ। আসলে সোজা, টানা সুতোর বুনোটে যেমন সুতোরগোলা, কাপড় হয়ে ওঠে, তেমনি ইচ্ছের টানা পোড়েন নিয়েই মানুষের মানুষ হতে থাকা। তবে হ্যা, ক্ষমতার সাথে ইচ্ছের একটা গলাগলি সম্পর্ক আছে।আর ক্ষমতাটা মূলত দু-ধরনের, এক- ধনের, দুই- মনের। মন থাকলে মনে ইচ্ছের জন্ম হয়, হবেই। ইচ্ছে থাকলেই ধন জন্মে না। তবে ইচ্ছে বাঁচবে কিনা, কতদিন বাঁচবে সেটা মনের জোরের ওপর যেমন ধনের জোরের ওপরও নির্ভর করে। দুর্বলরা মনে মনে হেরে ভূতহলে ইচ্ছেও মরে।নিজেও মরে নিজের কাছে। টাকার জোরে অবশ্যই কিছু ইচ্ছের পরমায়ু কিছু বৃদ্ধি করা যায়।
আদতে মনলোকেই ইচ্ছের বাস।ধনলোকে নয়। যে কারণে কবির সাথে কুবেরের সখ্যতা কম।আঁকচা- আঁকচিও বেশ।মনবশ কবি ধনবশ হতে পারে, ধন যে কবির বশ নয়। ধনতণ্ত্রর সূত্র আলাদা। বাজার বাজার বাজার!বাজারের ইচ্ছে থাকে, ইচ্ছের কোন বাজার নেই।বাজার কৃতকার্যর দাম দেয়,ইচ্ছের কোন দাম নেই। বাজার দাম ঠিক করে, ইচ্ছে দামের পরোয়া করে না।ইচ্ছে ব্যক্তিক, বাজার নৈর্ব্যক্তিক।এই নৈর্ব্যক্তিকতাকে ভাঙার শক্তি শুধু ব্যক্তিরই থাকে।ইচ্ছের মূল্যে দামের বাজার ভাঙার ক্ষমতা ব্যক্তি পায় সম্মিলিত ইচ্ছের জোরে,যাকে সাধারণের ইচ্ছে বলে। এই ইচ্ছের ক্ষমতা অপরিমেয়।এই ইচ্ছে সর্বশক্তিমান। এবং স্বাধীন। 
 চারপাশের টুকরো দেখাগুলো, অভিজ্ঞতাগুলো ইচ্ছের পাল্লায় পড়ে নতুন অবয়ব নিয়ে সামনে গোপনে হাজির থাকে সুযোগের অপেক্ষায়।একের ইচ্ছা বহুতে ছড়িয়ে ‘সাধারণের ইচ্ছা’ হয়ে ওঠে।সে বড় সামাজিক। ব্যক্তির মাথার ছাতা। বিকাশের আশ্রয়।
লালকমল সাধারণের ইচ্ছের বেপথুপনার দিকে নজর রাখে নীলকমল ব্যক্তির ইচ্ছে।তার নিদ্রা মানায় না।  
ঘোড়ার পিঠে ডানা, কিম্বা বকের সাথে কচ্ছপ মেলানো, ইচ্ছের কেরামতি। রোজকার প্রয়োজনে না লাগুক পক্ষীরাজঘোড়া কি বকচ্ছপ দেখেশুনে অন্যকারো মনে এরোপ্লেন কি রোবটের ইচ্ছেচিত্র জাগেনি তাতো নয়। বিচিত্র পক্ষীরাজ ঘোড়া, বকচ্ছপ রোজকার প্রয়োজন মেটায়নি,এরোপ্লেন-রোবটতো  প্রয়োজন মেটাচ্ছে। ইচ্ছের নিবাস সেই বিচিত্রে, তাই ইচ্ছের আছে অসামান্য বৈচিত্র।সেটাই তার শক্তি।
সবার ওপর মানুষ যে সত্য-সেটা ব্যক্তি মানুষের অতন্দ্র ইচ্ছের প্রকাশ,সাধারণের ইচ্ছের শীলমোহর পেয়েছে। 
‘তাসের দেশ’এই সত্য মানতে চায় না।। 
             ( কবির গান ) 
             “   ইচ্ছে! —ইচ্ছে!                                                                                                                                                       সেই তো ভাঙ্গছে, সেই তো গড়ছে,
      সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।। 
সেই তো আঘাত করছে তালায়,            সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়—
                                   বাঁধন পরতে সেই  তো আবার ফিরছে।।“
                  
 (কবিতা) ইচ্ছে
  অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
 
ইচ্ছে আমার বুকের ভেতর ভাসায় মধুকর,
ইচ্ছে আমার ঘরের চাবি খুলছে অনন্তর।
উড়ছে পুড়ছে ছড়িয়ে দিচ্ছে শুকনো ভস্ম ফুল,
ইচ্ছে আমার ফিনিক্স পাখি সূক্ষ্ম থেকে স্থূল-
সবের মাঝে আলোক রেখা আমার ইচ্ছে নদী,
 মরুর পায়ে জলের নুপূর জড়ায় নিরবধি ।
আমার পিঠে লাগাই আমি আমার ইচ্ছে ডানা,
অসহ্য সব শোক দুঃখে আহ্লাদে আটখানা।
ইচ্ছে নিবিদে জড়িয়ে রাখা আমার কল্পলতা ,
ইচ্ছে আমার মন্দাকিনী প্রবল খরস্রোতা। 
ইচ্ছে গাড়ি, ইচ্ছে বাড়ি, ইচ্ছে রাস্তাঘাট –
ইচ্ছে মতন পার হয়ে যাই তিরপুন্নির মাঠ। 
ইচ্ছে রেখায় স্বপ্ন দিয়ে আঁকছি ইচ্ছে পট,
ইচ্ছে লড়াই ইচ্ছে সন্ধি ইচ্ছে ধর্মঘট।
ইচ্ছে করেই ইচ্ছে মতন আলোয় অন্ধকারে-
ইচ্ছে গাছে ইচ্ছে গজায় ইচ্ছামতীর পাড়ে।
ইচ্ছে আমার ভালবাসা স্বেচ্ছানির্বাসন, 
ইচ্ছে আমার বাঁচিয়ে রাখে ইচ্ছা বৃন্দাবন।।
 
 
           
  (গল্প) শেষ ইচ্ছে 
              
অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় বিচারে বসে জজ্সাহেব আসামীকে একটা গল্প বলছিলেন ।
“শুনুন তবে বলি, একবার এক ফাঁসির আসামীকে তার বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন, কালবাদে পরশু আপনার ফাঁসি হবে-বলুন আপনার শেষ ইচ্ছে কী?    
আসামী চুপকরে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। সে মুখও ফেরায় না, কথাও কয় না।
 বিচারক ফের জিজ্ঞাসা করলেন-আপনি কি আপনার সদ্যোজাত ছেলের মুখ দেখতে চান? মা’র সাথে কথা বলতে চান? নাকি বিশেষকিছু খাবার ইচ্ছে আছে? 
মাথায় গন্ধতেল মাখবেন?
 আসামী এবারেও রা কাড়ে না। বিচারক ভীষণ রেগে হাতের কাঠের হাতুড়িটা দিলেন ঠুকে ঠকাসকরে।
রাগটা বেশী ছিল, খটাস করে ভেঙ্গে গেল টেবিলের কোণটা।
আসামী অমনি বলে উঠল-হুজুর আমার এটাই ছিল শেষ ইচ্ছে, একবার অন্তত আপনার হাতুড়ির ঠকাসটা শুনবো। 
বিচারক তো অবাক, এই তোমার শেষ ইচ্ছে মানে ? এইটুকু?
আসামী ,একটু থেমে থেমে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে-হুজুর আমি কামার।লেখাপড়া জানি নে,মখ্যু মানুষ। সারাদিন হাতুড়ি পিটে কাজকরি।সেদিন দুপুরে হাপড় ধারে বউ ভাত নে এল। খিদেয় আমার পেট জ্বলছিল। ভাতের ডাবা খুলে দেখি ভাত ঠাণ্ডা -জল। দশবার তাকে শুধোলুম, হ্যারে ভাত ঠাণ্ডা কেনে? যত শুধোই তত চুপ, তত চুপ।    শেষে রাগ রুখতে না পেরে হাতের ধারের হাতুড়ি দিয়ে দিলুম এক ঘা। ব্যাস আবাগী গেল মরে, আর আপনি বিচেরকরে দিলেন আমার ফাঁসির হুকুম।এখন শুধোচ্ছেন আমার শেষ ইচ্ছে কী। বাবুমশাই  দেখলেনতো রাগ কি বস্তু? তিনবার শুধিয়ে জবাব না পেয়ে, আপনি শিক্ষিত মানুষ অবধি রেগে মেগে আপনার হাতেরকাছের কাজের হাতুড়ি দিয়ে দিলেনতো টেবিলটার মাথা ভেঙ্গে।ভাাগ্গিস আমি দূরে ছিলুম। নয়তো আপনাকেও তো এতক্ষণে ফাঁসির হুকুম মাথায় নিয়ে শেষ ইচ্ছে বলতে হত। বলুন দেখি- আপনার শেষ ইচ্ছেখানা কী?”
 
এ গল্প শেষ করে জজ্সাহেব আসামীর দিকে তাকিয়ে ছলছলে চোখে জিজ্ঞাসা করলেন-
“বলুনতো ,আমার শেষ ইচ্ছেটা কী”? 
আসামী মাথা নীচু করে নিশ্চুপ। 
জজ্সাহেব প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, “প্রতিবার ভাবি,শেষ ইচ্ছে জানাটার বুঝি এই শেষ! এখনোতো  বেশ কিছু বছর এই কুর্সি তে থাকতে হবে। শেষ ইচ্ছে জানাটা এবার শেষ হোক, এই আমার শেষ ইচ্ছে।“
আদালত মুলতুবি হয়েগেল।

Related Posts

Leave a Reply