May 7, 2024     Select Language
৭কাহন Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু উল্টে যাচ্ছে না

[kodex_post_like_buttons]
কলকাতা টাইমস :
সব কেমন ম্যাজিকের মতো রোজ পাল্টে যাচ্ছে। কাল যেটাকে জানতাম আধুনিক, আজ সেটাই পুরোনো। হাতে পাওয়া নতুন মোবাইল ফোনটাকে গত তিন মাসেও ঠিক পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি, এরই মধ্যে শুনি সেটটা নাকি পুরোনো হয়ে গেছে, নতুন মডেল চলে এসেছে। বাড়িতে ৬০ ইঞ্চি ফ্ল্যাট এলইডি টিভি কিনে এনে কিছুদিন পরই বুঝতে পারলাম, আমার ১৪ বছরের ছেলের কাছে ১২ ইঞ্চি ট্যাবের স্ক্রিনই যথেষ্ট, ওটাতেই নেটফ্লিক্স চলছে। বড় ফ্ল্যাট টিভিরও দরকার নেই, কেব্‌ল চ্যানেলেরও দরকার নেই—তাই একসঙ্গে পরিবারের সবাই মিলে বসে এইসব দিনরাত্রি দেখাও নেই।
শুধু কি তাই, ছেলের বয়স ১৫-১৬ হলেই বাবাদের কাজ ছিল শেভ কীভাবে করতে হয় ছেলেকে দেখিয়ে দেওয়া, আর তাতেই ‘ভয়ংকর’ বাবা আস্তে আস্তে বন্ধু হয়ে উঠবেন শেভ করা শেখাতে শেখাতে। আর এখন ১৬ বছরের ছেলেটি ইউটিউব দেখেই শেভ করা শিখে নিচ্ছে। তাই বাড়ির বাইরে কোথাও ছেলেমেয়েরা উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেললে মুরব্বিরা চাইলে ‘বাড়িতে কিছু শেখায়নি নাকি?’ প্রশ্ন পাল্টে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ‘ইউটিউব কিছু শেখায়নি নাকি?’
তাই এখন যা শেখার, ওদের কাছ থেকেই শিখতে হবে। কীভাবে মোবাইলের নতুন অ্যাপ থেকে সহজেই বিনা মূল্যে কল করা যায় কিংবা কীভাবে ফিল্টার ব্যবহার করে নিজের চেহারা আমূল পাল্টে দেওয়া যায়। সারা জীবন বড়রা শিখিয়েছেন, ‘যখন কোনো কাজ করবে, শুধু সেই কাজটাই মন দিয়ে করবে’, আর আজকাল দেখছি ছেলেপেলে দিব্যি একসঙ্গে দুটো-তিনটে কাজ করছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আমরা মাঠে-ময়দানে, ক্যানটিনে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা মেরেছি, এখন আর ওসবে চলছে না, নতুন নতুন চোখধাঁধানো অন্দরসাজের ক্যাফে খুলেছে, তার সঙ্গে নতুন সব দাঁতভাঙা নামের চা আর কফি।
আগের সেই গরম জলে উথলানো জ্বাল দেওয়া কড়া দুধ চা দিয়ে আর চলছে না, মানুষের পছন্দের নানা পদের চা। আর কফির নামের লম্বা তালিকা তৈরি হয়েছে। কারও কফিতে দুধ দিলে সমস্যা, কারও চায়ে চিনি দিলে সমস্যা, কাউকে শুধু লিকার দিলে সমস্যা—গ্রিন টি চাই। সেই চায়ে একবার এক চুমুক দিয়েছিলাম, দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার আর সাহস পাইনি। কিন্তু সময় পাল্টাচ্ছে, পছন্দ পাল্টাচ্ছে, আমাদের ভালো লাগায় বা না লাগায় কিছু যায়-আসে না।
মানব-মানবীর প্রেমের সম্পর্কের সংজ্ঞাও বেশ পাল্টে গেছে।
জীবনে প্রেম একবার আসে, শুনলে আজকের ছেলেমেয়েরা হেসে খুনই হয়ে যাবে। আবার বন্ধু আর প্রেমের মাঝখানেও নানা রকম নতুন নতুন সম্পর্কের নতুন নতুন শেড কিংবা বৈচিত্র্য এসেছে। ‘আমরা এখনো একজন আরেকজনকে দেখছি-জানছি’, ‘ভালো লাগছে, কিন্তু এখনো এটাকে প্রেম বলা যাবে না’, ‘হুট করে ভালোই লেগেছিল, এখন আর লাগছে না’, ‘বিশেষ বন্ধু, তবে এখনো প্রেমিক নয়’, এমন আরও নানান জটিল বিশেষণ-বিশ্লেষণ, সম্পর্কের স্থায়িত্ব আসার আগেই।
আমাদের একটু অস্বস্তি লাগছে বটে, তবে এটাই বোধ হয় ভালো। হৃদয় ভাঙার আগেই যদি বোঝাপড়াটা সেরে নেওয়া যায়, তাহলে আর হৃদয় ভাঙার ওই কষ্টের মধ্য দিয়ে যাওয়ার দরকারটা কী? তৈরি হোক ভগ্নহৃদয়-বিবর্জিত নতুন দিনের এক প্রেমিকসমাজ।
আর বর্তমানে বুঁদ হয়ে থাকা আধুনিক মানুষের সময় কোথায় হৃদয় ভাঙবার আর হৃদয় জুড়বার!
একেকটা দিন যেন একেকটা জীবন। ওই এক দিনেই এত কিছু ঘটছে যে আগামীকাল নিয়ে ভাবার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। ওই এক দিনেই ঘটে যাচ্ছে এক জীবনের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, হাসি-কান্না, সমাজকে নিয়ে নতুন ভাবনা কিংবা ফেসবুকে উত্থাপিত সামাজিক আন্দোলন, ওই দিনই ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাহলে কি ব্যক্তিতান্ত্রিক এই মানুষের চোখে বাসা বাঁধবে না এক অগ্রসরমাণ ভবিষ্যৎ সমাজ তৈরির স্বপ্নের ঘোর?
উত্তরণের পথ কি তবে রুদ্ধ? আমার মনে হয় না। আজকের এই রোজ পাল্টে যাওয়া সমাজে, ব্যক্তিতান্ত্রিক মানুষ আসলে মনোযোগী নিজ বর্তমানকে পরিপূর্ণ করে তুলতে। তাই প্রতিটা ইট এত যত্ন করে তৈরি যে ইমারত সুন্দর হতে বাধ্য। এটাই আজকের দিনের নতুন মন্ত্র। ব্যক্তি তার নিজ প্রয়োজনেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বহাল রেখে একে অপরের সঙ্গে স্বপ্ন ভাগাভাগি করে নিতে রাজি, সমাজ গড়তে রাজি। খেলার নিয়ম একটু পাল্টে যাওয়াতে আমাদের একটু সমস্যা হচ্ছে বটে, তবে আমাদেরও মানিয়ে নিতে হবে, শিখে নিতে হবে। মাঝেমধ্যে ওদেরও ভুল হবে, তখন আমরা আবার আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসব।
আদিম মানুষের স্বপ্নের কথা বলব, স্বপ্নপূরণের পথে মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার গল্প বলব, পাথরে পাথর ঠুকে আগুন আবিষ্কারের কথা বলব। শুনে ওরা ওদের নতুন কম্পিউটার সফটওয়্যার আবিষ্কারের গল্পের সঙ্গে আদিম মানুষের মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার গল্পের মিল খুঁজে পাবে। তারপর দুজনে হাত-ধরাধরি করে নতুন যৌথ খামার তৈরির পথে এক পা দুই পা করে এগোতে থাকব।

Related Posts

Leave a Reply