May 18, 2024     Select Language
৭কাহন Editor Choice Bengali KT Popular শারীরিক

এখন ১৪ দিনেই অতিষ্ঠ, ২৬ বছর কোয়ারেন্টিনে ছিলেন ‘টাইফয়েড মেরী’

[kodex_post_like_buttons]

কলকাতা টাইমস :

বিশ্বে চলছে করোনা তাণ্ডব। এমন অসুখ যা চুলেই ১৪ দিন সোজা কোয়ারেন্টিনে। সেই১৪ দিন ঘরবন্দি থাকতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্তু যদি ২৬ বছর আপনাকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয় তাহলে? আর তখন যখন আপনার মনে হবে আপনি সুষ্ঠ-সবল। ভাবছেন সম্ববই নয়।  কিন্তু সত্যি-সত্যিই ২৬ বছর একজন মানুষকে  কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল। তার নাম মেরী ম্যালন।  মেরী ম্যালন নামের এক হতদরিদ্র আইরিশ তরুণী ১৮৮৪ সালে  ভাগ্য অনুসন্ধানে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে থিতু হয়েছিল। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সে গৃহস্থালী কাজকর্মকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পরবর্তীতে সে ভালো রাঁধুনি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এ তরুণী সেসময় ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিধানে সে ‘টাইফয়েড মেরী ‘ হিসেবে খ্যাত হয়ে থাকবে। 

বিংশ শতাব্দির প্রথমভাগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি টাইফয়েড জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ে প্রধানত দূষিত জল ও দুর্বল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে। এটি বড় বড় শহরগুলোর গরীব লোকজনের মধ্যে বেশি দেখা যেত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এটি ধনীদের বাসগৃহেও দাপটের সাথে হামলা করতে শুরু করে। শুরু হয় নিউইয়র্ক স্বাস্থ্য বিভাগের গবেষণার কাজ। এই গবেষণার ফলাফলটি ছিল ভীষণ অবাক করা একটি ব্যাপার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন সুস্থ বাহকের মাধ্যমে এই রোগটি ছড়াচ্ছে বলে প্রমাণিত হয়।

মেরী ম্যালন প্রথমদিকে নিউইয়র্কের ধনী পরিবারগুলোতে গৃহস্থালি কাজের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। পরে সে এসব পরিবারেই রাঁধুনি হিসেবে কাজ করে। চার্লস হেনরি ওয়ারেন নামের একজন ধনী ব্যাংকার ১৯০৬ সালে লং আইল্যান্ডের ওয়েস্টার বে এলাকায় পরিবার নিয়ে শুধুমাত্র গ্রীষ্মকাল কাটানোর জন্য একটি বাড়ি ভাড়া করেন। তিনি মেরীকে ওই বাড়ির রাঁধুনি হিসেবে নিয়োগ দেন। মেরী ওই বাড়িতে যোগ দেবার তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিবারের একজন সদস্য টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়। এরপর এ সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে পরিবারের আরও পাঁচজন সদস্যের মধ্যে। উল্লেখ্য, যে এই পরিবারে মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১১ জন। ওয়ারেন পরিবার এ নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তাই সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ার জর্জ সোপারকে এ বিষয়টি তদন্তের জন্য নিযুক্ত করা হয়। তার তদন্ত প্রতিবেদন ১৯০৭ সালের ১৫ জুন নিউইয়র্ক স্টেট জার্নাল অফ মেডিসিনে (জামা) প্রকাশিত হয়। সোপার  প্রথমে ধারণা করেন যে সুপেয় জলের ক্ল্যমস থেকে এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তিনি ওই পরিবারের অসুস্থ লোকজন ও রাঁধুনি মেরীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।

সোপার মেরীকে বর্ণনা করেছেন এভাবে—৩৭ বছরের একহারা গড়নের তরুণী যার উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি, হলুদাভ গায়ের রঙ, উজ্জ্বল নীল চোখ, বলিষ্ঠ চিবুক ও মুখ। সন্দেহাতীতভাবে মেরী ছিল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এরপর তিনি রসুইঘর পরিদর্শনে যান। রান্নাবান্নার খবরাখবর নিয়ে জানতে পারেন যে ওখানে মশলাযুক্ত গুরুপাক খাবার তৈরি করা হয় যা থেকে রোগজীবাণু সংক্রমণ একেবারে সম্ভব নয়। কিন্তু ডেজার্ট হিসেবে মেরীর তৈরি মজাদার ও জনপ্রিয় খাবার ছিল টাটকা পীচফল দিয়ে সাজানো আইসক্রিম। এই ডেজার্টের দিকে সোপার সন্দেহের তীর ছোঁড়েন। এ কাজে নিযুক্ত থাকার সময়ে তিনি আরও জানতে পারেন যে, সে গত কয়েক বছর মোট আটটি পরিবারে রাঁধুনির কাজ করেছে। এর মধ্যে সাতটি পরিবারের ২২ জন সদস্য টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ও ৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানেন এইভাবে যে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে রাঁধুনির অমনোযোগীতার কারণে Salmonella typhi নামের এই ব্যকটেরিয়া খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।

এর পরের ধাপ ছিল স্বাভাবিকভাবেই মেরীর মলমূত্র ও রক্ত পরীক্ষা। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার কথা বলতেই সে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ও কাঁটাচামচ হাতে নিয়ে সোপারকে তাড়া করে। মেরী সারাজীবন বিশ্বাস করেছে যে সে খুবই ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী একজন মানুষ এবং সে কখনও রোগের কারণ হতে পারে না বা রোগ ছড়াতে পারে না । ১৯০৭ সালে  Salmonella typhi নামের ব্যকটেরিয়া দ্বারা নিউইয়র্কের ৩০০০ অধিবাসী আক্রান্ত হয় যার মধ্যে প্রায় দশ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। মনে করা হয় যে, এই রোগ ছড়ানোর মূল কাজটি মেরীর মাধ্যমে হয়েছে। কিন্তু একজন সুস্থ বাহকের মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর ইতিহাস এই প্রথম। ১৯১১ সালের আগে টাইফয়েড জ্বরের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি আর অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়েছে আরও অনেক পরে ১৯৪৮ সালে। সার্বিক জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে মেরী ম্যালনের মতো একজন বিপদজনক বাহককে থামানো ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছিল । তাই সোপার উপয়ান্তর না দেখে স্বাস্থ্য বিভাগ ও পুলিশের সহায়তায় তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালে পাঠালেন। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় মেরী সেখান থেকেও পালানোর চেষ্টা করে। অবশেষে তাকে বাগে এনে তার মলমূত্র ও রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় তার দেহে Salmonella typhi নামক ব্যকটেরিয়ার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর তাকে নিউইয়র্ক থেকে নর্থ ব্রাদার দ্বীপের রিভারসাইড হাসপাতালে সংলগ্ন একটি কটেজে জোরপূর্বক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়।

এর ঠিক দুইবছর পর ১৯০৯ সালে মেরী নিউইয়র্ক স্বাস্থ্য বিভাগের বিরুদ্ধে মামলা করে যা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় কিন্তু মামলাটি ধোপে টেকেনি। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত এই দুইবছর তার মল ১৬৩ বার পরীক্ষা করা হয়। বলা বাহুল্য যে প্রতিবারই Salmonella typhi ব্যকটেরিয়া পজিটিভ ছিল। যদিও সে প্রতিবার  এটি অস্বীকার করছিল। তাই ডাক্তারেরা তার সাথে কথা না বাড়িয়ে তাকে শুধু গলব্লাডার অপারেশন করার জন্য বারবার অনুরোধ করছিলেন। এই অনুরোধে সে একেবারে সাড়া দেয়নি । কিন্তু ১৯১০ সালে নতুন স্বাস্থ্য কমিশনার মেরীকে কোয়ারেন্টিন থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তার জন্য তিনি চাকরিরও ব্যবস্থা করেন এই শর্তে যে সে আর কখনও রান্নাবান্নার কাজে করতে পারবে না। প্রথম কিছুদিন এই শর্ত মেনে সে ধোপার কাজ ও গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ করে। কিন্তু রান্নার প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ ও এটি তার জন্য ছিল ভীষণ রকমের নেশা আর এতে ভালো পারিশ্রমিকও পাওয়া যেতো। এ কারণে শেষ পর্যন্ত সে শর্ত ভঙ্গ করে নাম বদলে নিজেকে আড়াল করে রাঁধুনি হিসেবে কাজ শুরু করে। এবারে সে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির হোটেল, রেঁস্তরা, বোর্ডিং হাউস, স্পা ও হাসপাতালে কাজ করে। তার এই কাজ আবারও সার্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বিশাল হুমকি হয়ে দেখা দিল। ম্যানহাটনের স্লোএইন মেটারনিটি হাসপাতালে কাজ শুরুর তিনমাসের মধ্যে ২৫ জন মানুষ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়। এরা ছিল ওই হাসপাতালের ডাক্তার,  নার্স ও সাধারণ কর্মচারী। এবারও স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ার জর্জ সোপার তাকে এক ধনী ব্যক্তির বাসা থেকে খুঁজে বের করেন। তার মাধ্যমে এ রোগ আবার ছড়ানোর কারণে সে চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

নিউইয়র্ক আমেরিকান জার্নাল প্রথমবারের মতো তাকে ‘টাইফয়েড মেরী’ নামে অভিহিত করে। ডক্টর বেকার, যিনি মেরী ম্যালনকে একজন সুস্থ ও নীরব বাহক হিসেবে নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, বলেছেন যে এটা খুবই দুঃখজনক যে মেরী আমাদের কাউকে বিশ্বাস করেনি এবং একেবারে সহযোগিতা করেনি।

দ্বিতীয়বারের মতো নিউইয়র্ক স্বাস্থ্য বিভাগ তাকে ২০১৫ সালে জোরপূর্বক কোয়ারেন্টিনে পাঠায়। এবারেও তার জায়গা হয় নর্থ ব্রাদার দ্বীপের রিভারসাইড হাসপাতাল সংলগ্ন একটি কটেজে। সেখানে সে তার বাকি জীবন অতিবাহিত করে। দুইবারে সে প্রায় ২৬ বছর কোয়ারেন্টিনে ছিল। জানা যায় যে মেরী এসময় ধর্মকর্মে  মনোনিবেশ করে। প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে সে খ্রীষ্ট্রধর্মকে আকড়ে ধরে একাকী জীবন কাটিয়ে দেয়। এ কঠিন সময়ে তার বইপড়ার অভ্যাসও গড়ে উঠে। ১৮৬৯ সালে আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী মেরী ম্যালন ১৯৩৮ সালে একাকী, আত্মীয় পরিজনহীন অবস্থায় নর্থ ব্রাদার দ্বীপে মৃত্যুবরণ করে। তার এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি বিশ্লেষকদের নতুন করে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। আসলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা অন্য জরুরি বিষয়ের তুলনায় কী একেবারেই মূল্যহীন? জনস্বাস্থ্যের কথা বলে মেরী যে একজন ব্যক্তিমানুষ তার অস্তিত্বকে কী একেবারেই অসম্মানিত করা হয়নি? মনুষ্যসমাজের সাথে তুলনায় ব্যক্তিমানুষ কী নিতান্তই তুচ্ছ? এটাও আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে যে, নিউইয়র্ক স্বাস্থ্য বিভাগ টাইফয়েড জ্বরের সংক্রমণ নিয়ে যতটুকু উদ্বিগ্ন ছিল এর ছিটেফোঁটাও ছিল না ব্যক্তি মেরীকে নিয়ে। অনেকে এর কারণ হিসেবে মনে করেন সে ছিল একজন নারী অভিবাসী, দরিদ্র ও সহায়সম্বলহীন। এ কারণে তার প্রতিবাদের কণ্ঠটিও ছিল দুর্বল। দুর্ভাগা মেরীর এই রোগটির বাহক হবার ব্যাপারে কোনো হাত ছিল না। কিন্তু তার ভাগ্য তাকে মনুষ্যসমাজ হতে বিতাড়িত করেছে আর সে দুর্নাম  কুড়িয়েছে সংক্রামক ব্যাধির বাহক হিসেবে। বিভিন্ন পত্রিকার কার্টুনে ও কৌতুকে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ  করা হয়েছে যা কোনভাবেই তার প্রাপ্য ছিল না। সে রান্নাবান্নাকে পেশা হিসেবে নিয়ে একটি সাধারণ জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় কোয়ারেন্টিনে কাটিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার ঠাঁই হলো ‘টাইফয়েড মেরী’ নামের বিশেষণ নিয়ে।

Related Posts

Leave a Reply