April 26, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

মান সিং যেন চম্বলের রবিনহুড…. 

[kodex_post_like_buttons]

মান সিং রবিনহুড এর কাহিনি জানত কি না জানা নেই। কিন্তু আশ্চর্য মিল দু জনের। খুন, ডাকাতি যা হয়েছে তা সবই হয়েছে সামন্তপ্রভূদের ওপর। কোনো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সামন্তপ্রভূদের সম্পদ লুঠ করে গরিবগুর্বদের মধ্যে বিলি করে দেওয়াই ছিল মান সিংএর মহত্ব।

সৌগত রায় বর্মন

আসলে এরকম অভূতপূর্ব, অলৌকিক, দূরন্ত যাত্রা ক’জন বাঙালির জীবনে ঘটেছে তা জানা নেই। মনে হচ্ছিল বন্ধুদের ডেকে বলি, দ্যাখ কেমন লাগে। মাটির তলায় যে এরকম পাহাড় থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আর তেমনি সরু পথ। দুপাশে খাড়াই দেওয়াল। পাথরের নয় মাটির। কখনো ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে। কখনো কাঁটা গাছের ঘায়ে জামা ছিড়ে যাছে। মাথার উপর সূর্য। কখনো দেখা যাচ্ছে কখনো যাচ্ছে না।
 দুটো উটে আমরা দুজন। সঙ্গে আরও দুটো। তাতে দুজন দুজন করে চারজন গ্রামবাসী। আমাদের গাইড কাম দেহরক্ষী। বন্দুক চারটে। এ’সব তো থাকবেই, কিন্তু যে জিনিসটা আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে তা এখন আর কেউ দেখতে পাবে না, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। ভিস্তি। চামড়ার তৈরী জল ধরার ব্যাগ। দীর্ঘ বেহড়ের রাস্তায় জল আদপেই মিলবে কিনা জানা নেই। বেহড়ে কেউ নেই যে জলসত্র নিয়ে বসে আছে। তাই দুই ভিস্তি জল যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে ।
আমরা যে পুরো পথটা বেহড় দিয়েই যাচ্ছি তা নয়। মাঝে মাঝেই সমতলে উঠেছি। তখনই প্রাণ ভরে নি:শ্বাস নিয়েছি। আর কতটা যেতে হবে?  এই প্রশ্নটা শুনে শুনে ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জিজ্ঞেশ করতেই বলে আউর থোড়া । আ গেয়া। আমরাও বুঝতাম এটা ওদের শান্তনা ।
এবারের পথটা দীর্ঘতম। হাতের ঘড়ি বলছে তিন ঘন্টা চলে এসেছি। আর কতদুর যাবো? এক ঘন্টার বেশি নয় নিশ্চয়!. যতই উত্তেজনা মনের মধ্যে থাক, বেহড়ের উঁচু নিচু পথে যেতে, তার উপর আবার উটের পিঠে আমাদের জন্ডিস অবস্থাটা বুঝতে নিশ্চয় কারোর অসুবিধা হচ্ছে না।
এখন আর থামা নেই। জলতেষ্টা পেলে একটু দাঁড়িয়ে যাওয়া, ব্যাস। আমরা আরো প্রায় দুঘন্টা ক্যামেল রাইড করে অবশেযে সমতলে ল্যান্ড করলাম। রতন হাসি-হাসি মুখে জানালো, এটাই খেরা রাঠোর। মান সিং এর আবাস ক্ষেত্র। তার হাভেলি। আপনারা দাঁড়িয়ে থাকবেন না। হাত পা ছাড়িয়ে নিন। নইলে পিঠে খিঁচ ধরে যাবে। আমি হাভেলি থেকে পারমিশন নিয়ে আসছি। আপনারা অপেক্ষা করুন।
আমরাও যেন তাই চাইছিলাম।মান সিং এর বড়দা বড়েবাবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে মনটাকে শক্ত করে নেওয়া দরকার।
আবার প্রতিক্ষা। কিন্তু কম সময়ের জন্য। আধঘন্টা পর দূত রতন ফিরে এসে বলল, আপনারা যেতে পারেন। আমরা বললাম, তোমরা যাবে না? রতন গম্ভীর হয়ে বলল, বেশি লোকজন বড়েবাবা পছন্দ করে না। আপনারা যান। মোহরচাচা আপনাদের সঙ্গে যাবে।
মান সিং এর দলের এক নম্বর হিটম্যান ছিল তার বড়ে ভাই নবাব সিং। ১০৩টি খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ৫৫ সালে যে ব্রাহ্মন পরিবার তল্ফিরামের সঙ্গে, কুয়োর জল তোলা নিয়ে তার বচসার জেরে একটি পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল, তার মূল পান্ডা এই নবাব সিং। মান সিং নাকি নিজের হাতে একটিও হত্যা করেনি। হত্যার মূল দায়িত্ব ছিল নবাব সিং এর হাতে।
মান সিং এর ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও নেতৃত্ব দেবার জন্মগত ক্ষমতা। নবাব সিং এর মতো ট্রিগার হ্যাপি, খুঁখার, বদমেজাজি খুনিও ছোটভাই মান সিং এর নেতাগিরি এক কথায় মেনে নিয়েছিল। 
মান সিং রবিনহুড এর কাহিনি জানত কি না জানা নেই। কিন্তু আশ্চর্য মিল দু জনের। খুন, ডাকাতি যা হয়েছে তা সবই হয়েছে সামন্তপ্রভূদের ওপর। কোনো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সামন্তপ্রভূদের সম্পদ লুঠ করে গরিবগুর্বদের মধ্যে বিলি করে দেওয়াই ছিল মান সিং এর মহত্ব। মানুয সামাজিক বিচার পাওয়ার জন্যও মান সিং এর কাছে আসত। পুলিশ বা প্রশাসনের পায়ে তেল মেরে দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হওয়া তাদের বিলকুল না পসন্দ। যে কোনো বাগী সে সমস্যা অনেক দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্য করতে পারে। তাই বাগীদের সেই অর্থে সমান্তরাল প্রশাসন বলা যেতেই পারে।
কিন্তু সাবধান। পুলিশকে কোনো মতেই সাহায্য করা যাবে না। তাহলে মৃত্যু অনিবার্য। ডাকাতদের হাল হকিকত জানতে পুলিশ গ্রামের মানুযদের মধ্যে মুখবির বা গুপ্তচর নিয়োগ করে ঠিকই। কিন্তু মান সিং এর জানকারি থেকে তারা রক্ষা পায়নি। রবিনহুডের সঙ্গে এখানেই মান সিং এর মিল। 
নবাব সিং ছিল এই দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। নিশ্চিত ফাঁসির দড়ি থেকে তাকে মুক্ত করে আনেন বিনবা ভাবে, ডাকাতদের হৃদয় পরিবর্তনের ডাক দিয়ে।
মধ্যাহ্নের রোদ তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। আমরা দু’জন আর মোহরচাচা বাপ মায়ের উদ্দেশ্যে শেয প্রনাম নিবেদন করে হাঁটতে লাগলাম মান সিং হাভেলির দিকে। সদরের সামনে এসে মোহরচাচা ঠোঁটে আংগুল দিয়ে আমাদের কথা না বলতে বলল। আমাদের বাইরে রেখে ভিতরে চলে গেল। আধো আধো শুনতে পেলাম বড়েবাবার সঙ্গে কথা হচ্ছে মোহরচাচার। মনে হল, তীরে এসে তীর ফস্কে যাবে না তো। বেশ কিচুক্ষণ আশংকার মধ্যে কাটানোর পর দেখলাম মোহরচাচা বাইরে এলো। মুখে বিজয়ীর হাসি। আমাদের পিঠে হাত দিয়ে বলল, যান, তবে আগে প্রনাম করবেন, তারপর কথাবার্তা।
খুনি, হত্যাকারি, ডাকু বা বাগী যেই হোক না কেন, ১০৩টি খুনের মামলা যার নামে, তাকে দেখতে যাওয়ার আগে হাঁটু যে ঠক ঠক করে কাঁপবে, তা স্বাভাবিক। আমাদের নড়তে চড়তে বেশ সময় লাগছে দেখে মোহরচাচা ঘাড়ে ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল।
ঢুকে দেখি বিরাট বড় হাভেলি। মাঝখানে উঠোন। তাকে ঘিরে চৌদিকে ছোট ছোট ঘরের সারি। একতলা। একটা দিক ফাঁকা। সেখানে একটা অপূর্ব কারুকাজ করা একতলা দালানকোঠা।  তার সামনে দুটো উট। বাধা। তাদের লম্বা গ্রীবা যেন ঠাকুর সম্প্রদায়ের গর্ব ঘোষণা করছে।
এত গেল এক পলকে চারপাশটা জরিপ করে নেওয়া। 
কিন্তু উঠোনের ঠিক মাঝখানে যিনি খাটিয়ার তাকিয়ায় ভর করে বসে আছেন,  তিনি কে? স্বয়ং নবাব সিং? হতেই হবে। গায়ে খদ্দরের চাদর। খাটো ধুতি উঠে এসেছে হাটুর ওপর। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ডান কান নেই। নিশ্চয় গুলিতে উড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি যে ঝাপসা তা বোঝা গেল, আমাদের দেখেও না দেখার কারনে।
প্রনামের কথা মনে পড়তেই যৌথ ডাইভ মারলাম খাটিয়া তাক করে। ল্যান্ড করলাম ঠিক খাটিয়ার সামনে। লং জাম্পে বব বিমনকে পরাজিত করা যেন আমাদের কাছে কিছুই নয়। শোয়া অবস্থাতেই দেখলাম চোখের উপরে নবাব সিং এর চরণ যুগল। দুজনেই তার পায়ে মাথা রেখে অপেক্ষা করছি, বুলেটটা ঠিক কোথায় লাগবে, গর্দানে না ব্রহ্মতালুতে, তাই ভাবছি।  কিন্তু না তা তো হল না। আমাদের মাথায় শীর্ণ হাতের ছোঁয়া পেলাম। মাথা তুলে দেখি, নবাব সিং আমাদের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
লং জাম্পে প্রনামের ফল তাহলে ফলেছে। ভাঙা-ভাঙা গলায় বড়েবাবা জিজ্ঞেশ করলেন, তুম লোগ কলকত্তাকা লেড়কা? মুঝে দেখনে কে লিয়ে ইতনা দূর সে আয়া?
আমরা মিউ মিউ করে বললাম, আপনাকে দেখা মানে তো শিউজীর দর্শন পাওয়া।
১০৭ বছরের খুঁখার বৃদ্ধ বাগী এ কথা শুনে খুশি হলেন। বললেন, আমি কলকাতার বড়বাজারে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে ছিলাম। অল্প অল্প বাংলা জানি। বল, কি শুনতে চাও? তোমরা ছাড়া আমি কিন্তু বাইরের কারোর সঙ্গে এতদিন কথা বলিনি। তোমরা আমার কোঠিতে এসেছো। মেহমান। তাই বোলছি। বল, কি শুনতে চাও? মনে মনে ভাবছি, নতুন করে কী আর শুনবো। লোকমুখে যা শোনার তা তো শুনেই ফেলেছি। এরকম পুরুষকে চোখে দেখা কী কম কথার।
মৃদুল দা কথা শুরু করল। নবাব সিং শুনলেন। কী যেন ভেবে হঠাত চিৎকার করে উঠলেন, রামদিন! মেরে বন্দুক লে আও। 
সুদুর উত্তরপ্রদেশের গণ্ড গ্রাম খেরা রাঠোরে আমরা কোনো হিন্দি সিনেমার শুটিং দেখছি না। যা দেখছি তা বাস্তব। অতি বাস্তব। নবাব সিং তার বাগী জীবনের কথা বলবে, হাতে বন্দুক থাকবে না, তা কি করে সম্ভব?
এই একটা ডাকের মধ্যে যেন তার ক্ষত্রীয় পৌরুষ প্রকাশিত হল।
রামদিন বড়েবাবার দীর্ঘদিনের সহচর। প্রথমেই নবাব সিং কে বুলেটের মালা পড়িয়ে দিল। বন্দুক কিন্তু দিল না। ফুট দশেক দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আচমকাই নবাব সিং এর দিকে ছুড়ে দিল বন্দুকটা। কী রিফ্লেক্স! ডান হাত দিয়ে ছোঁ মেরে লুফে নিল বড়েবাবা। শূন্যে ট্রিগার টিপে নিশ্চিত হল, বুলেট নেই।
মৃদুলদার দিকে ফিরে বলল, আভি পুঁছো, কেয়া পুছনা হ্যায়।
বড়েবাবার বয়েস তখন ১০৭ বছর। আমরা ফিরে আসার পর তার ইন্তেকাল হয়, ১০৯ বছর বয়েসে।
এই সবকিছুই প্রকাশিত হয়েছিল ৮০ সালের  “পরিবর্তন ” পত্রিকায়। স্বচিত্র।
আফশোস রয়ে গেল, সেই ছবি আর আমার হাতে নেই। কিছু ছিল ওই পত্রিকা অফিসে। বন্ধ হয়ে যাবার পর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। আমার নিজস্ব নেগেটিভ নষ্ট হয়ে গেছে কিছু আনিবার্য কারনে।
তবে স্বহৃদয় পাঠককে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, খুঁজে পেলে প্রকাশিত হবে। আমি খোঁজে আছি। খোঁজ পেলে জানাবো।
(ক্রমশ)

Related Posts

Leave a Reply