May 5, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

এ্যাকোরিয়াম (গল্প)

[kodex_post_like_buttons]
অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় 
বাড়ির উল্টোদিকে হঠাৎই একদিন সক্কালে দেখলাম অবিনাশ !ঝুড়িতে সাজানো গোছানো তিন চাকার একটা রিক্সা ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার তিন তলার ঝোলানো বারান্দা থেকে ওকে স্পষ্ট দেখলাম। ও আমায় দেখেনি। উত্সাহে ‘অ_বি_না_শ-‘বলে বাজখাই চেঁচিয়ে ডাকলামও।
ও ওপর দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। চিনতে পেরেছে বলে মনে হল না। 
আরো বার দুই ডাকলাম।কিন্তু ও না দিল সাড়া না তুলল আর চোখ। 
অভিমান? হবে হয়ত। 
স্কুলের বন্ধু। এক শহরেই বাড়ি। তবুতো তেতাল্লিশ বছর কেউ কারো খবর রাখিনি। 
অথচ এক সময়ে-আমি আর অবিনাশ ছিলাম ছোটবেলার ন্যাংটো পোদের বন্ধু।
তখন আমরা ছিলাম গরীব। আর অবিনাশরা দারুন অবস্থাপন্ন। কত বড় বাড়ি, গাড়ি! ওর বাবার কত বিশাল ব্যবসা!সে তুলনায় আমাদের টিনের চালা।বাবা হাতিবাগানে কাপড়ের দোকানের সামান্য কর্মচারী! দুবেলা কষ্টকরে চলে আমাদের।থাকার মধ্যে ছিল খালি আমার পড়াশোনা। আমি স্কুলের ক্লাসের ফার্স্ট বয়! আর অবিনাশ? ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চার। 
অংক ইংরেজিতে আমি বরাবরই ভাল ছিলাম বলে অবিনাশের বাবাই মাধ্যমিকের আগে ওদের বাড়িতে যেয়ে একসাথে পড়তে বলতেন, তাতে যদি অবিনাশের অংক ইংরেজিটা ভাল হয়।উতরায় ম্যাট্রিক্। অবিনাশের বাবা এটাও বলতেন,–‘সত্সঙ্গে স্বর্গ বাস অসত্সঙ্গে…’ইত্যাদি। 
আমার মা বাবা এ প্রস্তাবে নিষেধ করেননি কখনো। ওদের বাড়ি গেলে তবুতো এটা ওটা ভাল মন্দ খাবার জুটতো। আলো পাখা এমনকি গরম কালে এসির ঠাণ্ডাও! বাবা বরাবর বলতেন- 
-‘ভালতো ভালই,খারাপেরে ভাল করতে পারলে তবে না বুঝি এলেম’! 
অবিনাশরা ছিল দু-ভাই,এক বোন। অবিনাশই বড়। ওর বাবা প্রায়ই বলতেন-
‘ আগের হাল যে দিকে যায় পাছের হালও সে দিকেই যায়’।
অবিনাশ ঠিক চললে ওর ভাই বোনটাও ওর পিছু পিছু একদিন উতরে যাবে,এ বিশ্বাস ছিল ষোলআনা। 
এই সরল সমাধান সূত্রেই ওদের বাড়িতে আমার ছিল অবাধ যাতায়াত!নিজে পড়াশুনায় এগুতে পারেন নি বলেই অবিনাশের বাবার বড় আস্থা ছিল আমার ওপর। সাথে সাথে তার সন্তানেরাও পড়াশুনা কিছু করুক,  এ চাওয়াটাও মিথ্যা ছিলনা।বরং একমাত্র মেয়েকে আলাদা করে পড়ালে মাসে পঞ্চাশটা করে টাকা দেবার ব্যবস্থা অবধি করেছিলেন।কথাছিল ফাইন্যাল পরীক্ষার পরে মেয়ের পড়াশুনার পুরোপুরি দায়িত্ব থাকবে  আমার। মেয়েকে অবশ্য বেশি দিন পড়াতে হয় নি আলাদা করে।একা ঘরে সাতক্লাসের মেয়ের ধিঙ্গীপনায় অবিনাশের মা, ঘি আর আগুনকে আলাদা করতে সব্বাই মিলে এক ঘরে গোল হয়ে মেঝেয় বসার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে মেয়ের পড়ারইচ্ছেইটাই গেল মরে। তবে ম্যাট্রিক অবধি প্রতি মাসে পঞ্চাশটা টাকা নিয়ম করে দিতেন অবিনাশের বাবা। আমি না না করলেও শোনেন নি। দিতেন মা’র হাতে।মা’ও নিয়ে নিতেন। মা হয়ত অভাবে স্বভাব নষ্ট করেছিলেন।অথবা ভাবতেন মেয়ের জন্য জামাই বায়নার অগ্রিম টাকা দিচ্ছেন অবিনাশের বাবা, নিলে কি দোষ? তা সে যা ভেবেই হোক দেওয়া নেওয়া চলছিল। 
সে ওদের টাকা ছিল অনেক-পড়াশুনার মাথা ছিল কম। এ যদি সত্যি হয়, এটাও সত্যি,অবিনাশের ভাই ও বোনটি অন্যসব বিষয়ে ছিল পেকে ঝুনো। ভুল বানানের কম চিঠিতো আর পাইনি অবিনাশের বোনের!
নিজের ছেলে মেয়ের এইসব আটিকাঠি কাজের দিকে নজর না থাকলেও, অবিনাশের মা সখেদে বলতেন আমার নাকি পাশের মাথা,আর ওনার ছেলেমেয়ের সবার নাকি ফেলের মাথা!তবু চেষ্টাতো করবেনই। 
তা যাই হোক ম্যাট্রিকে আমি স্কলারশিপ পেলাম। অবিনাশ ইংরেজিতে ফেল করে গেল মাত্র দুটো নম্বরের জন্য। অবিনাশের বাবা তাতেই খুশি। 
সে দিন রেজাল্ট হাতে ও বাড়ি গিয়েছিলাম অবিনাশের বাবা মাকে প্রণাম করতে।সকালেই নাকি অবিনাশের বাবা কালীঘাট গিয়েছেন দুই ছেলে কে নিয়ে পুজো দিতে। বাড়িতে শুধু মা-মেয়ে। পরীক্ষার জন্য প্রায় মাস খানেক আসিনি এ বাড়িতে। ওদের বসার ঘরে ঢুকে চমক লেগে গেল। বেশ বড় একটা এ্যাকোরিয়াম রাখা রয়েছে ঘরের মাঝখানে! বুরবুরি কাটা জলের ভেতরে ঝকঝকে আলোয় খেলে বেড়াচ্ছে এক জোড়া রুই মাছের মত দেখতে মাছ! ওদের চার পাশে হিলিবিলি কেটে বেড়াচ্ছে এক ঝাক  লাল, কালো, হলুদ রঙের অজস্র ছোট ছোট মাছ।গোটা ঘরে অদ্ভুত আলোর খেলা।নানা রঙের ঝিকিমিকি। আমায় দেখেই অবিনাশের মা ভেতরের ঘরে উঠে গেলেন। নিশ্চিত গোষা করে। আমার পাশের মাথা, পাশ করে গেলাম।আর অবিনাশ গেল ফেল করে। মাকে বেরিয়ে যেতে দেখেই অবিনাশের বোন আমার দিকে অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে হাত দুটো ধরে প্রায় জড়িয়ে ধরে আরকি! ঝটকা মেরে ওকে সরাতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় ঝন্ ঝন্ করে মেঝেয় পড়ে গেল এ্যাকোরিয়াম।রক্তে ভাসল হাত, জলে ভাসল মেঝে।মেঝেয় পড়ে তড়বড় করে লাফঝাপ শুরু করে দিল ছোট বড় রঙিন মাছ। অবিনাশের বোন আত্কে তুতলে এমন চেঁচিয়ে উঠল আমি দৌড়ে সেই সে বাড়ি ছেড়ে পালালাম,আর ঢুকিনি। আজ পর্যন্ত না।বদলে যাওয়া আমার ছোটবেলার হাফ শহরের পুরনো ঘর বাড়ি ডোবা পুকুর রাস্তা সব যে উধাও।  হারিয়ে গেছে অবিনাশদের বাড়িটাও।আমাদের বাড়ির জমিতেও এখন আকাশি বহুতল।এক একটা যেন মানুষ রাখার এ্যাকোরিয়াম! কত আলো! কত রঙের আলো ! সবমিলিয়েই গ্রেটার কোলকাতা। 
আমার ম্যাট্রিকে পাশের বছরেই,বাবা বাড়ি বেচে আরো একটু গ্রামে চলে গিয়েছিলেন মাকে নিয়ে। আমিও সেই যে হোষ্টেলে ঢুকলাম সেখান থেকে বিদেশ, বিদেশ থেকে গোটা চাকরী জীবন দিল্লি। শেষে অবসর নিয়ে শুধু মাত্র অশীতিপর মার অনুরোধে পুরনো আমার জন্মস্থানে ফিরে আসা। এই ফ্লাট কেনা। এবং আজ হঠাৎ তিন তলার বারান্দা থেকে এতদিন পরে অবিনাশের দেখা পাওয়া। 
অতবার ডেকেও অবিনাশের সাড়া না পেয়ে দু হাঁটুতে নি-ক্যাপ লাগিয়ে লাঠি হাতে লিফটে চেপে রাস্তায় নেবে এলাম খুড়িয়ে। ওকে ধরে একবার শুধু জিজ্ঞাসা করবো বলে।
-‘হ্যারে অবিনাশ,সেদিন যে এ্যাকোরিয়ামটা ভেঙ্গে রঙিন মাছগুলো মাটিতে ছড়িয়ে গিয়েছিল,মেঝেতে খাবি খাচ্ছিল,সেগুলো বাঁচাতে পেরেছিলি রে’?                                          তখনো ফাঁকা রাস্তায় তিনচাকার সাজানো ভ্যানটা দাঁড়িয়েছিল।ভ্যানে একটা ঝুড়ি।ঝুড়িতে নানা রকমফের মাছ।  রুই, কাতল, পার্শে,পুঁটি,মোরলা,ত্যালাপিয়া। ঝক্ ঝক্ করছে সকালের রোদে।
অবিনাশের মত অবিকল দেখতে, অবিনাশ নয় একজন মাছ বেচছে। অবিনাশ কোথাও নেই।

Related Posts

Leave a Reply