May 3, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular রোজনামচা শিল্প ও সাহিত্য

পুরুষতন্ত্রের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ফুলন তৈরি করল আরেক নিষ্ঠুর ইতিহাস  

[kodex_post_like_buttons]

আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ১১)

সৌগত রায়বর্মন:

” ম্যায় ক্যা রেন্ডি হ্ন” ? ফুলনের গর্জন শুনএ আমাদের কি অবস্থা হতে পরে, সেটা বোঝা নিশ্চয় কঠিন কাজ নয়। তার চোখের দিকে তাকাতেও যেন ভয়ে আমাদের চোখমুখ প্রায় কাঁদো কাঁদো হতেই যেন ঈশ্বর প্রেরীত দূত হিসেবে সামনে এসে পড়ল ফুলন প্রেমিক মান সিং।

ফুলনের মাথায় হাত বুলিয়ে সে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সত্যিই তাই হল। আগুনকে যেমন জল বশ করে সেভাবেই ফুলন নামক এক আগ্নে়গিরির লাভা সে নিজের হাতে মেখে ফুলনকে স্নেহ মমতায় আদর করতে লাগল।

কিছুক্ষণ বাদে ফুলন শান্ত হল। চুপ করে বসে রইল, মাটির দিকে তাকিয়ে। বড্ড ভালো লাগছিল তার বসার ভঙ্গি। পরে মান সিং জানিয়েছিল, এই চন্ডি স্বভাবের জন্যই তাকে সমাজে বারবার লাঞ্ছিতা হতে হয়েছিল প্রবল পরাক্রমশালী পুরুষ শাসনের কাছে। উল্টোদিকে এই বিদ্রোহ না থাকলে কি সে এভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে? ২২ জন ধর্ষককে পর পর হত্যা করতে পারে?

ফুলনের বান্ধব মান সিং এগিয়ে এল আমাদের সামনে। বলল, আপনাদের যা জানার আছে জেনে নিন আমার কাছ থেকে। ফুলনের আজ মুড ভালো নেই। দিল্লির এক সাংবাদিক নাকি ফুলনের ইন্টারভিউ নিয়েছিল কয়েকদিন আগে। তার লেখায় ফুলনকে একেবারে রেন্ডি কা অনুভুতি দিয়েছিল। ও নাকি শরীর দান করে বিভিন্ন ডাকাত সর্দারদের সহযোগিতা আদায় করেছিল । সেটা সত্যি না। প্রতিহিংসার কারণেই ফুলন ডাকাত দলে নাম লিখিয়েছিল।

মান সিং শুরু করল ফুলনের কাহিনী যা উপন্যাসের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

বেহময় বেহমাই হত্যাকাণ্ড যা ঘটিয়ে রাতারাতি ফুলন আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি লাভ করেছিল সেই কাহিনীর আড়ালে আছে আরো একটা কাহিনী।

বাবুরাম গুর্জরের লোভ ও লালসার স্বীকার হতে হয়েছছিল ফুলনকে। তারপর পালিয়ে গিয়ে সাহায্য আশা করেছিল ফুলন। কিন্তু সে আশা তার অপূর্ন থেকে যায়। মালখান তাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বাধ্য হয় সে বাবুরামকে বাবু হিসেবে মেনে নিতে। তার রক্ষিতা হয় ফুলন। সে কিন্তু প্রতীক্ষায় ছিল। কবে এই লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেবে?

কিছু দিনের মধ্যেই তার বাসনা পূর্ণ হল। বাবুরামের কর্নেল ছিল বিক্রম সিং মালহা। জাতের হিসেবে ফুলন তার নিজের জাত। বিক্রম বাবুরামকে মেনে নিতে পারেনি, ফুলনের ওপর এই লোভ ও লালসা দেখে । অসহায় ফুলন কে সে হয়তো ভালই বেসে ফেলেছিল।

একদিন প্রকাশ্যে গর্জে ওঠে তার রাইফেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বাবুরাম । সে সময় দলে বাবুরাম এর প্রতি বাকি ডাকাতদের অনাস্থা প্রকাশ পাচ্ছিল তার নারী পিপাসার জন্য।  সুতরাং বাবুরাম নিহত হওয়ায় কেউ কোনো বিদ্রোহ করেনি। মেনে নিয়েছিল।

দলে নতুন সর্দার মনোনীত হল বিক্রম সিং মালহা । ফুলন ধরা দিল বিক্রম এর বাহুবন্ধনে।

শুরু হল আরেক প্রেম পর্ব। বিক্রম ও ফুলন। কেউ আপত্তি করেনি। বিক্রম ফুলনকে বেহড়ের অন্ধকারে বন্দুক চালানো শেখায়। বন্দুকের প্রতি ছোটবেলা থেকেই ফুলনের একটা টান ছিল। বিক্রম তার সেই সাধ পূরণ করে।

শুরু হলো প্রকৃত ডাকাত এর জীবন। বিক্রম যখন এনকাউন্টারে বা ডাকাতিতে যেত সঙ্গী হত পুরুষবেশী ফুলন। এমন কী পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারেও ফুলন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল।

কিন্তু এই অঞ্চলটা প্রতিহিংসার আদি বাসভূমি। এখানে জলে জঙ্গলে মাটিতে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে প্রতি নিয়ত।

একদিন গুর্জর ঠাকুরদের একটা বড় সড় দল হানা দিল বিক্রম সিং এর গোপন ডেরায়। ডাকাতদের গুলিতে মারা গেল আরেক ডাকাত। বিক্রম সিং মালহা । প্রতিশোধ গুর্জর বংশজাত বাবুরামকে হত্যার। বিক্রম এর দলবলকে নিকেশ করে ফাউ হিসেবে তুলে নিয়ে যাওয়া হল, ২২ বছরের নধর ফুলনকে। কোথায়?

ইতিহাস প্রসিদ্ধ সেই বেহমাই গ্রামে। প্রতিহিংসার আগুনে ঝলসে যাওয়া সে গ্রামের নাম আজও সবার মনে আছে সম্ভবত ।

এই গ্রামেই ফুলনকে লাগাতার ধর্ষণ করে ২২ জন পুরুষ। এই নারী মাংস ভোজন চলে টানা তিন দিন।

সভ্যতার ইতিহাসে এরকম নৃশংস ঘটনা বোধহয় আর কখনো ঘটেছে বলে জানা যায়নি। ভারতের দরিদ্রতম আনাচে কানাচে কি ঘটছে তার কতুকুই বা আমরা জানি!

ফুলন কিন্তু সেই হায়নার ডেরা থেকেও পালাতে সক্ষম হয়।

কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায় ? সেই ভাবনা সে আগেই ভেবে রেখেছিল।

গহন রাতে পালিয়ে পাক্কা দুদিন, আলোয় লুকিয়ে, অন্ধকারে পথ চিনে চিনে সে পৌঁছে যায় সেই বাবা ঘনশ্যাম এর আস্তানায়। এই সেই ডাকু, যার খোঁজে জান হাতে করে আমরা বুন্দেলখণ্ড জঙ্গল অভিযানে গিয়েছিলাম। ঘনশ্যাম একটুর জন্য ফসকে গিয়েছিল।

যাই হোক ঘনশ্যাম কিন্তু মালখানের মত ফুলনকে অস্বীকার করেনি। বরঞ্চ তার প্রতিহিংসার কাজে সহায়তা করেছিল। কেনো?

কারণ ফুলনের মত সে নিজেও মালহা জাতিভুক্ত। একই বলে জাতের টান।

তখন ফুলনের দলবল বলে কিছু ছিল না। ঘনশ্যাম নিজের দলের কিছু নিউ রিক্রুটকে ধার দিয়েছিল ফুলনকে।

১৯৮১, ১৪ ফেব্রুয়ারি ফুলনের নেতৃত্বে একটা বেশ বড় দল আচমকা হানা দিল তার লাঞ্ছনার ভূমি বেহমাইতে। বাবা ঘনশ্যাম সেই দলে ছিল কিনা সেটা স্পষ্ট করে জানায়নি মান সিং।

সে দিন প্রকাশ্য দিবালোকে ফুলন লাইন দিয়ে পর পর হত্যা করে তার ২২ জন ধর্ষক বৃন্দকে। এক এক করে বুলেটে ছিন্ন ভিন্ন করে দিল এক একজন রেপিস্টকে ।

পুরুষতন্ত্রের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তৈরি হল আরেক নিষ্ঠুর ইতিহাস।

ফুলন হল চম্বল কি রানী।

কিন্তু ইতিহাস যাকে একবার নির্বাচন করেছে তার কি এত সহজে নিস্তার আছে?

ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবার পর ফুলনকে কী নিষ্ঠুর সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার বিবরণ দিলে গা শিউরে উঠবেই যে কোনো পাঠকের। ঠিক সে সময়ে যখন সে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু নিজ শর্তে। ঠিক সে সময়েই তার দেখা পেয়েছিলাম আমরা।

পরবর্তী পর্যায়ে তার উত্থান লক্ষ্য করেছি একজন ভক্তের চোখে, দুর থেকে।

এলো ১৯৯৬ সাল। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তখন মুলায়ম সিং যাদব। সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে ফুলন। এই তো সুযোগ ! সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী করা হল ফুলনকে। মির্জাপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হল ফুলন।

বিহার থেকে দিল্লি। মাটি থেকে মসনদ। ফুলন স্থাপিত হল লোকসভার সদস্য হিসেবে। ফিনিক্স পাখির এই যাত্রা পথ যে কতটা কণ্টকাকীর্ণ তা আলোচনা করা যাবে পরের অধ্যায়ে।

ক্রমশ

Related Posts

Leave a Reply