May 3, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular রোজনামচা শিল্প ও সাহিত্য

‘সে ও জানতো ফিনিক্স পাখিকেও একদিন অগ্নিদগ্দ্ধ হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়তে হবে’

[kodex_post_like_buttons]

আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (শেষ পর্ব )

সৌগত রায় বর্মন 

আমরা ফিরে এলাম। সবাই খুশি।পার্থ দার গম্ভীর মুখে এক চিলতে হাসি। ফুলনের সঙ্গে দেখা করে এসেছি, সম্পাদকের বুক তো গর্বে ফুলে উঠবেই।

তারপর নানা কাজে মনে দৈনিক অ্যাসাইনমেন্টের বোঝা বইতে বইতে দিন কাটতে লাগল। ফুলন নামের এক ফিনিক্স পাখির নাম কখনো মনে আসে আবার হারিয়েও যায়। কিন্তু ফুলনের ব্যাপারে আমাদের তথ্য সংগহ্ চলতেই থাকে।

ফুলনকে জেল খাটতে হয়েছিল ১১ বছর। তবে ঘানি টানতে হয়নি। ব্যাপক আরাম ও সম্মানের সঙ্গেই তার জেল জীবনের সমাপ্তি হল একদিন।
শর্ত অনুযায়ী তাকে হাতকড়া পরানো যায়নি।
সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে জেলখানা ছিল তার পক্ষে সব চাইতে নিরাপদ আশ্রয়।
১৯৯৬ সালে উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব ফুলনের ওপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নেন। তাকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করা হয়।
ফিনিক্স পাখি ফুলন আবার খবরের শিরোনামে উঠে আসে। 
সমাজবাদী পার্টি তাকে লোকসভায় প্রার্থী করে মির্জাপুর কেন্দ্র থেকে। ফুলন বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ভারতীয় পার্লামেন্টের আবার ইতিহাস রচনা করলেন ফুলন। 
কোনও ঘোষিত ডাকাত সর্দার আর যাই হোক সংসদে স্থান পায়নি। এখানেও একমাত্র ফুলন। 
আমরা সাবাস বলে চেচিয়ে ছিলাম, বলেছিলাম ফিনিক্স পাখির মৃত্যু নেই।
আগেই আলোচনা করা হয়েছে , চম্বলের আকাশে বাতাসে প্রতিহিংসার আগুন আজও জ্বলছে।
শ্রীকৃষ্ণকেও মরতে হয়েছিল সামান্য এক ব্যাধের তীরে। ফুলনকেও মরতে হল কঠোর নিরাপত্তা বলয়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। দিল্লিতে তার সাংসদ বাসভবনের সামনে। প্রকাশ্য দিবালোকে।
হত্যাকারী সেই বেহিমাই গ্রামের একজন উচ্চবর্ণের যুবক । শের সিং রানা ও তার দুই সঙ্গী।
তাকে হত্যা করা হয় পয়েন্ট রেঞ্জ থেকে। পিস্তলের গুলিতে। ২৫ জুলাই, ২০০১। 
অর্থাৎ ৩০ বছর ধরে এই শের সিং এবং আরও অনেকে অপেক্ষা করেছিল, কবে ফুলনকে একা পাওয়া যাবে।
আসলে এই হত্যাকারী বেহোমাই গ্রামের উচ্চবর্ণের ঠাকুর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। তার বাবা ছিল ফুলন ধর্ষনের এক পান্ডা। ফলত তাকে নিহত হতে হয় ফুলনের হাতে। শের সিং তখন নিতান্তই শিশু। ক্রমশঃ বড় হতে হতে সে শুনেছিল কি করে তার বাবাকে ফুলন হত্যা করেছিল। 
বেহমাই গ্রামে তাকে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয় যাতে সে একদিন ফুলনকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পারে।
ফুলনকে হত্যা করা হয় ঠিক সেই মুহুর্তে যখন সে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়। 
মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন ফুলন আশ্চর্য রকমের নিবিড় শন্ততার মধ্যে কাটিয়ে ছিল। ফুলনের পরিচারিকার কাছ থেকে তেমনটাই শোনা গেছিল।
তাহলে কি সে জানতো ফিনিক্স পাখিকেও একদিন আকাশ থেকে পড়তে হবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে?
ফুলন মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর ডাকাত হয়েই থাকবে। কিন্তু তার উত্থান-পতন তো আর মিথ্যে হবে না। আবার বলা হচ্ছে, ফুলনকে ‘ভারতীয় জোয়ান অব অর্ক’ বললে কোনও অন্যায় হবে না 
বছর কয়েক আগে আগ্রা থেকে জয়পুর যাওয়ার পথে একটাও ময়ূর দেখিনি। অথচ চল্লিশ বছর আগে এইসব রাস্তায় ময়ূর ঘুরে বেড়াত যত্রতত্র। মনে প্রশ্ন আসায় এক সিঙারা(পানিফল) বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করায় সে হাসতে হাসতে বলল, “চম্বলে আর বুলেটের শব্দ শোনা যায় না। ময়ূর নাচবে কোথায়?”

সত্যিই চম্বল নদীর দু’পাশ এখন বিদ্রোহী বা বাগীশূন্য হয়ে পড়ছে। যাদের কথা এতক্ষণ ধরে আলোচনা হল তারা ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আগ্নেয়-প্রতীক। সংবিধান অনুযায়ী যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধী তারাই ডাকাত, দেশদ্রোহী, উগ্রপন্থী ইত্যাদি। 

আমাদের অভিযান শুরু হয়েছিল মানসিং, নবাবসিংকে দিয়ে। শেষ হল জোয়ান অব অর্ক ফুলনকে দিয়ে। এই আলেখ্য কোনও উপন্যাস নয়। চম্বল থেকে সরাসরি ধারাভাষ্য। মাঝে কেটে গেছে দীর্ঘ সময়৷ পালটে গেছে চম্বলের বেহড়, বুন্দেলখণ্ডের জঙ্গল, ও মানুষগুলোও। কতদিন আর রক্তে প্রতিহিংসা পুষে রাখা যায়! আরও একটা প্রশ্ন মাথায় আসে, সংবিধান স্বীকৃত ডাকাতরা দখল করে নিয়েছে অসংবিধানিক রবিন হুডদের প্রতিষ্ঠান।

মালখান সিং-এর বয়স এখন ৭৬। কিছুদিন আগেই বলেছিল, “আমরা ডাকাতি করেছি ঠিকই কিন্ত কোনও গরীবের ভাত মারিনি, জোতদার, জমিদারদের আকণ্ঠ দৌলত আমরা লুট করে বিলিয়ে দিয়েছিলাম গরীব-গুর্বো চাষিদের মধ্যে। মাঝখানে ভেবেছিলাম রাজনীতি করব। কোনও দল আমাকে স্থান দিল না। কারণ আমি নাকি ডাকাত ছিলাম। হ্যাঁ ছিলাম, তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু যাদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না, দেশ তো দূরস্থান, তাদের ধনদৌতলের হিসাব কি আমরা রাখি?”

এশিয়ান গেমস রানার পানসিংকে তোমরা ডাকাত হতে বাধ্য করেছিল। সে পুলিশের গুলিতে মারা যায় ১৯৮১ সালে। তার ভতিজা বলবন্ত সিং-এর গলায়ও একই কথা। সে জানালো, “এ দেশে গরীবের জন্য কোনও আইন নেই, যা আছে সব বড়লোক আর উচ্চবর্ণের লোকজনের জন্য। কৃষক না খেতে পেয়ে মরলে খুনিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদেশে কোনও নেতা না খেয়ে নিহত হয় না। ভারতের প্রত্যেক নেতার বাড়িতে বোধহয় টাকা ছাপানোর মেশিন আছে। নইলে তাদের কাছে এত বস্তাভরা টাকা কীকরে থাকে?” সে আরও জানালো, “যে গ্রামের মাণ্ডি বা বাজারগুলি নিয়ন্ত্রণ করে এই রাজনৈতিক ডাকাতরাই। কোন জিনিসের দাম বাড়বে আর কমবে তা নির্ভর করে নেতাদের উপর, কৃষকদের উপরে না।” 

এই মুহূর্তে শান্তি যেন লগ্ন হয়ে আছে চম্বলের মাটিতে। রবিন হুডের দল ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। ময়ূর নাচেনা বুলেটের শব্দে। কেনই বা নাচবে? ময়ূর নাচানোর বন্দুক ছিল যাদের হাতে সেই বন্দুক ডাকাতি হয়ে গেছে একদল অসভ্য, বর্বর ভণ্ড-দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক ডাকাতদের হাতে। বেহরের রুক্ষ জীবনে থেকে কতটুকু আর ডাকাতি করা যায়! উচ্চবর্ণের জোতদার জমিদাররা আজ ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত। নিঃশব্দে ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা, যার জন্য দায়ী চম্বলের ডাকাতরা নয়। রাজনৈতিক ডাকাতরা।

এখন যারা ডাকাতি করে তারা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারা মাথায় ফেট্টি বেঁধে উটের পিঠে চড়ে না, কাঁধে রাইফেল নিয়ে চলে না, ধুতি পরে না। মাথায় ফেট্টি, কোমরে পিস্তল, হাতে দলীয় ঝাণ্ডা- তারাই আজ চম্বলের ডাকাত, বাগী নয়। 

Related Posts

Leave a Reply