April 30, 2024     Select Language
৭কাহন Editor Choice Bengali KT Popular সফর

অভিশপ্ত এই সিড়ি থেকে আজও রক্তের দাগ মুছে যায়নি 

[kodex_post_like_buttons]
কলকাতা টাইমস :

ক্তের দাগ কত দিন অটুট থাকতে পারে? প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে অনেকের মনে পড়ে যেতেই পারে লেডি ম্যাকবেথের কথা। শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে রাজা ডানকানকে খুন করার পরে মানসিক বিকার গ্রাস করেছিল যাকে। সেই সময়ে বার বার জলে নিজের হাত ধুতেন লেডি। রক্তের গন্ধ মুছে ফেলার জন্য ব্যবহার করতেন কত না সুগন্ধি! কিন্তু, তার মনে হত, এত করেও হাত থেকে রক্তের দাগ মুছল না!

লেডি ম্যাকবেথের যেটা হয়েছিল, সেটা নেহাতই অপরাধবোধ। কিন্তু, ভারতের দিল্লির খুনি দরওয়াজা-র সিঁড়ি থেকে আজও রক্তের দাগ মুছে যায়নি। এখনও স্পষ্ট দেখা যায় সেই দাগ। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গিয়েছে আর রক্তের রঙে কালচে থেকে কালচেতর হয়েছে সৌধের সিঁড়ি। যেন বা শতাব্দীর অপরাধ একজোট হয়ে গড়িয়ে পড়েছে সিঁড়ি বেয়ে রক্ত হয়ে! তার সঙ্গেই জমাট হয়েছে আতঙ্ক। যা আজও পর্যটকদের তাড়িয়ে বেড়ায়! বিপদে ফেলে!

কারণ খুঁজতে গেলে হাঁটতে হবে ইতিহাসের রক্তমাখা ধুলো-পথে। মজার ব্যাপার, একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই এই সৌধের যেন রক্ত বুকে মাখাটা ভবিতব্য ছিল। ১৫৪০ সালে শের শাহ সূরী যখন এই সৌধ নির্মাণ করেন, তখন এর নাম ছিল লাল দরওয়াজা। লাল পাথরে তৈরি বলে এই নাম!

নিয়তির পরিহাস আর কাকে বলে! কে জানত, এর পর শতক জুড়ে রক্তের লাল রং সারা শরীরে মেখে দাঁড়িয়ে থাকবে এই দরওয়াজা! তবে, অনেক ঐতিহাসিক শের শাহ সূরীকে খুব একটা সাফ ভাবমূর্তিতে দেখতে চান না। তারা বলেন, খুব ভেবে-চিন্তেই এই লাল দরওয়াজা নামটা রেখেছিলেন রসিক সুলতান। কেন না, তার সময়ে তিনি অপরাধীদের মস্তকচ্ছেদন করে, সেই কাটা মাথা আর ধড় আলাদা আলাদা করে ঝুলিয়ে রাখতেন এই ইমারতের দেওয়ালে।

শের শাহ সূরী এমনটা করতেন কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু এই সিলসিলাই তাঁর শাসন শেষ হয়ে গেলে জারি থেকেছে খুনি দরওয়াজার বুকে। নাম থেকে মুছে গিয়েছে লাল, কেবল তার দাগ জাঁকিয়ে বসেছে সিঁড়ির বাঁকে।

বেশির ভাগ ঐতিহাসিকই বলেন, লাল দরওয়াজা খুনি হল মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে। তখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন আকবর। সিংহাসন নিয়ে চলছে দ্বন্দ্ব। আর সেলিম এগোচ্ছেন জাহাঙ্গীর হওয়ার দিকে। রক্তের বিনিময়ে।
সিংহাসনে আসীন হওয়ার জন্য সেলিম প্রথমেই দূর করেন পথের কাঁটা আবদুর রহিম খানকে। রহিম খানের বাবা বৈরাম খানকে হত্যা করেন আকবর। তার পর বিয়ে করেন বৈরামের বিধবা স্ত্রীকে। সেই হিসেব মাফিক, রহিম খান সেলিমের সৎ-ভাই। দিল্লিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন রহিম। অতএব, তাঁকে দুই সন্তান-সহ খুন করা ছাড়া উপায় ছিল না সেলিমের কাছে।

সেলিম খুন করলেনও! রহিম খান আর তার দুই সন্তানকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিলেন লাল দরওয়াজার দেওয়ালে। নির্দেশ ছিল- পাখিতে ছিঁড়ে খাবে তাদের মৃতদেহ। তার পর নিশ্চিন্ত মনে সেলিম জাহাঙ্গীর নামে দখল করলেন ভারতের সিংহাসন। আর, শুরু হল লাল দরওয়াজার রক্তস্নানের অনন্ত অধ্যায়।

পরের পর্বটিও মুঘল যুগেরই। ঘটনাও এক- ভারতের সিংহাসন দখল। শুধু নায়ক আলাদা। তিনি ঔরঙ্গজেব। বৃদ্ধ শাহজাহানকে তিনি তখন সিংহাসন দখল করার জন্য বন্দী করে রেখেছেন আগ্রা দুর্গে। আর বড় ভাই দারাশুকোর মাথা কেটে সেটা ঝুলিয়ে রেখেছেন খুনি দরওয়াজার গায়ে।

এভাবেই আরও এক অভিজাত রক্তের স্বাদ নিল খুনি দরওয়াজা। কিন্তু তার তৃষ্ণা মিটল না। খুনি দরওয়াজায় এর পরের ধাপেও রক্ত লেগেছিল অভিজাত বংশেরই। তখন ভারতের বুকে জাঁকিয়ে বসছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। লখনউয়ের শেষ নবাব বাহাদুর শাহ জাফরকে পাঠানো হচ্ছে নির্বাসনে। কিন্তু, নির্মম হত্যার হাত থেকে রেহাই পাননি তার তিন সন্তান- মির্জা মুঘল, মির্জা খিজির সুলতান এবং মির্জা আবু বকর। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হাডসন এই খুনি দরওয়াজার কাছে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করেন তাদের। হত্যা করেন নবাব পরিবারের আরও অনেক সদস্যকেও। তার পর, প্রথামতো সবার মৃতদেহ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দরজার গায়ে।

খুনি দরওয়াজার ভৌতিক হয়ে ওঠারও সেই শুরু! অনেকে বলেন, বাহাদুর শাহ জাফরের তিন সন্তান আজও মুক্তি পাননি। অন্যায় ভাবে হত্যা করার জন্য তাঁদের আত্মা আজও প্রতি রাতে ঘুরে বেড়ায় এই অভিশপ্ত সৌধের চার পাশে। তাঁরা ভারতীয়দের কিছু বলেন না ঠিকই, কিন্তু বিদেশি দেখলেই তাদের প্রাণহানির চেষ্টা করেন। অনেক বিদেশিই জানিয়েছেন, রাতের বেলায় এই চত্বরে তাঁদের কেউ ধাক্কা দিয়েছে, মাথায় মেরেছে!

সেই জন্য সরকারি তরফেই রাতের বেলায় খুনি দরওয়াজার ধারে-কাছে বিদেশিদের যেতে দেওয়া হয় না। বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার পর এই বিষয়ে সতর্ক হয়েছে প্রশাসন।

সতর্ক হয়েছে আরও একটি দিক থেকে। আগে এই সৌধের ভিতরে যাওয়া যেত। এখন আর যাওয়া যায় না। জাল আর লোহার শিকে মুড়ে ফেলা হয়েছে চৌহদ্দি। সেটা অবশ্য শুধুই ভৌতিক উপদ্রবের জন্য নয়।

২০০২ সালে এই সৌধের ভিতরে ধর্ষিতা হয় এক তরুণী। তার পরেই বিশেষ করে বন্ধ হয়ে যায় ভিতরে যাওয়ার রাস্তা।

এই জায়গায় এসে কিছু প্রশ্ন মাথা চাড়া দেয়। খুনি দরওয়াজা কি তাহলে ভৌতিক, অভিশাপগ্রস্ত? অভিশাপগ্রস্ত তো বটেই! পর পর ঘটনাগুলো দেখুন না, সেই শের শাহ সূরীর আমল থেকে ভাল কিছু ঘটেছে কি এখানে?

আর ভৌতিক? সেটারও ব্যাখ্যা রয়েছে। নইলে প্রশাসন কেন রাত নামলে এই চত্বরে বিদেশিদের আনাগোনায় হস্তক্ষেপ করবে? তবু খটকা যায় না। অন্য নিহতদের ছেড়ে বিশেষ করে এই তিন ভাই-ই কেন প্রতিশোধস্পৃহায় দুর্মর হয়ে উঠবেন? উত্তর যা-ই হোক, সাবধান থাকতে ক্ষতি কী?

Related Posts

Leave a Reply