April 27, 2024     Select Language
৭কাহন Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

অন লাইনের গেরো

[kodex_post_like_buttons]

ভাবুক বাবুর ভাবনা

আলুর ইংরেজী পোট্যাটো, পেঁয়াজ অনিয়ন, বেগুন ব্রিঞ্জল, বাঁধাকফি ক্যাবেজ আর বড় জোর ফুলকফি কলিফ্লাওয়ার- শাকসবজি নিয়ে গড়পড়তা বাঙ্গালীর ইংরেজী জ্ঞানের দৌড় মোটামুটি এই পর্যন্ত। পাড়ার বাজারে এই জ্ঞানই যথেষ্ট ছিল এতদিন। কিন্তু অধুনা করোনা আসার ফলে সারা পৃথিবী আক্রান্ত, রিয়ালিটি উধাও, শুরু হয়েছে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। বাজার আছে, দোকান আছে, কিন্তু কোথায় কেউ তা জানে না, জানার দরকারও নেই। সব কিছুই এখন অনলাইন। এবং সেখানেই গেরো।

আমার পরিচিতা এক গৃহিণী অনলাইনে পুঁইশাক, ওলকফি, পটল, ঝিঙে আর কচুর অর্ডার করতে গেলেন। ফল হল মারাত্মক। উত্তর এল,  Hebrew vegetables not available. মহিলা তাঁর ছোট ছেলের সাহায্য নিয়ে বারবার অর্ডার করার চেষ্টা করেন আর বারেবারে উত্তর আসে, “আমরা হিব্রু শাকসবজি বেচি না”।

এখন বাড়িতে বন্দী থাকতে থাকতে সকলেরই মাথার ঘিলু পচা গোবর হয়ে গেছে। সুতরাং এই রহস্যের সমাধান আর হয় না। এদিকে কন্টেনমেন্ট জোনে থাকার ফলে হেঁটে হেঁটে বাজার যাওয়ার সুযোগও নেই, বাজারটাই বন্ধ। কিন্তু বাড়িতে খাবারে টান পড়েছে। অগত্যা পরামর্শ নিতে তিনি ফোন করলেন তাঁর এক দিদিমনি বান্ধবীকে। বান্ধবী ইংরেজির শিক্ষিকা। তিনিই উপায় বাতলালেন। বললেন, অনলাইনে শাকসবজি কেনার আগে অনলাইনে একটা বই অর্ডার কর্‌- “ইংলিশ নেম অফ বেঙ্গলি ভেজিটেবলস”। যেমন কথা তেমন কাজ। বই এসে গেল। উনি এখন রোজ সকালে শাঁখ বাজিয়ে, ধূপধুনো জ্বালিয়ে শাকসবজির বিলিতি নাম মুখস্ত করছেন- বৈজ্ঞানিক নাম আর ইংরেজি নাম ঘেঁটে ঘ। অনেক দূর এগিয়ে গেছেন । এখন তিনি জানেন পটল হল ট্রাইকোসান্থেস ডায়োসিয়া, ঝিঙ্গে কুকুরবিটাসিয়া, সাধের পুঁইশাককে বলে বাসেলা অ্যালবা, কচুর নাম অ্যারাম। কিন্তু বানান? বাড়ির দেওয়ালে বাংলার সমস্ত শাকসবজির ইংরেজি নাম তিনি বড় বড় করে লিখে রেখেছেন, ইংরেজি হিব্রু সব রকম নাম শিখে নিয়েছেন। বলা তো যায়না কখন কোন্‌টা কাজে লাগে।

এই ক’দিন আগে আমাদের পাড়ার কাত্যায়নীকে দেখে আমি থ মেরে গেলাম। হাতে শাঁখা, পলা, মাথায় অ্যাত্তবড় সিঁদুরের টিপ, তার উপর ঘোমটা। প্রথমে তো আমি চিনতেই পারিনি। এই লকডাউনে কবে বিয়ে হল? এখন তো কোনো অনুষ্ঠানই হচ্ছে না। কৌতূহল চাপতে না পেরে ডেকে বললাম, “ কাতু, কবে বিয়ে হল রে? তোর বাবা তো কিছু বলল না!” কাতু এক গাল হেসে বলল, “ডোন্ট কল মি কাতু, আঙ্কল। দিস ইজ ক্যাটরিনা, ক্যাটরিনা কোভিট”। এবার বাংলা ইংরেজি  মিশিয়ে বলল, “ আঙ্কল, অ্যাকচুয়ালি ইয়েসটারডে আমার ম্যারেজ হয়ে গেছে, আমার হাজব্যান্ড ইজ অ্যান অ্যামেরিকান”। ডোনাল্ড ট্রাম্প কম্যুনিস্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছে শুনলেও এতটা অবাক হতাম না। ক্যাটরিনা এই করোনার বাজারে বিয়ে করে আমেরিকান হয়ে গেছে শুনে, মাইরি বলছি, মাই হৃৎপিণ্ড কেম টু মাই ফুট। কোনওরকমে তাল সামলে বললাম, “ কেমন করে হল, ক্যাট?” কাতু বলল, “লকডাউনে রেসিডেন্সে সিটিং থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম, তাই বোরডম কাটাতে ম্যারেজ করে ফেললাম”। আমি বললাম, “তা ক্যাট, তোর হাজব্যান্ড?” কাতু হেসে বলল, “অ্যাকচুয়ালি এখন ওসব লাগে না। অনলাইনে বুক করলাম, হাসব্যান্ডের প্রোফাইল পাঠিয়ে দিল, ব্যাস। ম্যারেজ হয়ে গেল। ও তো, মানে কোভিট ১৯, আমাকে নিয়ে ঊনিশবার বিয়ে করেছে। কুল, তাই না আঙ্কল?” আমি না বলে পারলাম না, “ তুই নবগ্রামের রাস্তায় বৌ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, তোর হাজব্যান্ড আমেরিকায়, দেখাসাক্ষাৎ হবে কি করে”? কাতুকুতু মার্কা হাসি দিয়ে কাতু বলল, “কেন, ভার্চুয়ালি হবে। ডোন্ট মাইন্ড আঙ্কল, এত ভেবো না। সব কিছুই হবে, তবে অনলাইনে”।  তারপর একটু লাজুক হেসে বলল, “আমি পরের মাসেই বেবী বুক করেছি, সাত দিনের মধ্যেই ডেলিভারি দিয়ে দেবে”। ন’ মাস দশ দিন জানতাম, কিন্তু মাত্র দশ দিনেই বেবী, অনলাইনে!

তখনও অচেতন হইনি, কিন্তু বাড়িতে ঢুকতেই পাড়ার সান্যালবাবু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি বলি, “কি হল, কাঁদছেন কেন? কেসটা কি?” উনি বললেন, “সব্বোনাশ হয়ে গেছে। আমার পুত্রবধূ অনেকদিন ধরেই বলছিল, বাবা, আপনার বুকের সাদা চুলগুলো উঠে গিয়ে চামড়ায় গর্ত হয়ে যাচ্ছে। যদি ওই লোমকূপ দিয়ে করোনা ঢোকে? সর্বনাশ হয়ে যাবে আমাদের। আমিও ভেবে দেখলাম, সত্যিই, করোনা ঢুকতে পারে না এমন কোনো ফুটো নেই। তাহলে উপায়? বৌমা বলল, আমি অনলাইনে আপনার জন্য দুটো ভেস্ট অর্ডার দিয়ে দিই। ভেস্ট, মানে গেঞ্জি? আমি কিন্তু কিন্তু করে বললাম, ভেস্ট বানানটা ইংরেজিতে জানো তো মা? সে ঝাঁঝিয়ে উঠল, আমার বাপের বাড়ির শিক্ষা নিয়ে শ্বশুরবাড়ির কোনো কথা আমি শুনব না। আমি মিনমিন করে বললাম, না, না, তোমার ইংরেজী জ্ঞান নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তোমার যা ইচ্ছে তুমি অর্ডার দাও বৌমা। ভেস্ট বানান ইংরেজিতে লিখল ভি ইউ ই এস টি। কোম্পানী ভাবল টাইপ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে, তারা দুদিন পরে দুজন জি ইউ ই এস টি (গেস্ট) পাঠিয়ে দিল। তারা আর যাওয়ার নাম করছে না, নট নড়নচড়ন। তারাই এখন অনলাইনে অর্ডার করে, আমার গিন্নী এখন রান্নাবান্না করে, বৌমা গেস্টদের সঙ্গে মিলে ফন্দী করছে বাড়িটা হাতানোর”। আমি সব শুনে বললাম, “আপনার ছেলে, সে কোথায়?” সান্যাল মশাই চোখ মুছে বললেন, “তপা? ও তো মুম্বইতে গিয়ে আটকে পড়েছে। অন লাইনে ফেরার কথা ছিল, –

অনলাইনে ফেরার কথা! বলেন কি?!

মানে ট্রেনে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু এখন তো ট্রেন বন্ধ”। অনলাইনে মানে ট্রেনে?! এবার আমি সত্যি সত্যি অজ্ঞান হলাম।

Related Posts

Leave a Reply