April 28, 2024     Select Language
৭কাহন Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

মুরগীর চার পা দেখেছো নাকি?

[kodex_post_like_buttons]

সৌগত রায় বর্মণ

মাছের বাজারে সবাই আমায় কেন যেন মামু বলে ডাকত। দেরী করে বাজারে যাওয়া আমার অভ্যাস। ততক্ষণে মাছ পচে মেছো ভূত হয়ে যেত। সেই ভূত আমার ঘাড়ে চাপাবে বলে বাজারিরা অপেক্ষায় থাকত। আমি বাজারে ঢুকলেই তাদের মধ্যে আনন্দের হুল্লোড় বয়ে যেত। চারদিক থেকে “মামা”, “মামু” ডাকে মনে আমার পুলক জাগত, চোখ জলে ভরে যেত। বাড়িতে তো ঝাঁটার বাড়ি ছাড়া কিছুই জোটে না, কিন্তু বাজারে এলে? যেন আমি বলিউড স্টার। মামু মামু ডাকে মেছো ভূতগুলোও বুঝি আনন্দে আত্মহারা হয়ে মাথায় উঠে ধেইধেই করে নাচত।

ব্যাগ ভর্তি মেছো ভূত নিয়ে বীরের মত বাড়িতে ফিরতাম। চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে বলতাম-ওগো, তোমার স্বামী যে টাকায় মাছ কিনে ফিরেছে সেই টাকায় হেলেঞ্চা শাকের এক আঁটিও পাওয়া যায় না। ঠিক তার পরের মুহূর্ত থেকে যে অভিনন্দন, যে হৃদয় বিদারক অভ্যর্থনা জুটত তা আমি চিনা ভাষাতেও প্রকাশ করতে পারব না, না, না, কিছুতেই না।

আমার বাজার করার ইতিবৃত্ত যে কোনও বাজারি সাহিত্যকে হার মানাবে। মানুষ তো কত কিছুই বদল করে- বাক্স বদল, বউ বদল, বর বদল ইত্যাদি। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, আমার মত বাজার বদল কেউ  করেনি, করবেও না। সেদিন ছিল মাসের শেষ রবিবার। বৌ হাতে দশ টাকা ন’ পয়সা ধরিয়ে দিয়ে বলল- আর টাকা পয়সা নেই। বাজারের সব থেকে সস্তা মাছ নিয়ে এসো। মাছ- মাছ- বুঝলে? মেছো ভূত নয়।

বাজারে যেতেই আবার সেই মামু-মামু রব উঠল। আবার আমার চোখ ছলছল। ওরা তো জানে আমার পকেটে কোনদিনই বেশি টাকা থাকে না, কিন্তু তাতেও ওদের কী আনন্দ! একেই বলে ভালবাসা। আমি কালুর কানে কানে বললাম, হ্যাঁরে, হাতে মাত্র দশ টাকা আছে (ন’ পয়সাটা চেপে গেলাম), মাছ  হবে? কালু দেঁতো হেসে বলল- মামু , ব্যাবাক লোকে তো মাছ কিন্যা পয়সা নষ্ট করে। আপনারে আইজ আর মাছ দিমু না। কানকো আর পিত্ত গলা ত্যাল দিমু। প্রোটিন, ভিটামিনে এক্কেরে থইথই করতাসে। ভাইজ্জা খাইবেন। বৌদিরে শুধু লক্ষ্য করবেন। একবার খাইলেই আপনারে দেইখ্যা মাথায় ঘোমটা দিয়া থাকব। আমার আবার চোখে জল এসে গেল। কালু আমার কথা এত ভাবে! আহা, ও বেঁচে থাকুক চিরকাল।

বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে গেল। বাড়ির কাছে আসতেই দেখি ষন্ডা মত একটা লোক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই সঙ্গীদের বলল- ব্যাটা ভেবেছিল আমার মাছ গেঁড়িয়ে চম্পট দেবে। আমিও ভগবান দাস। অ্যাই, তোরা লোকটাকে কই মাছের মত পিটিয়ে মার্‌।

পাড়া প্রতিবেশীর মহান হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম। আসলে –“ভগবানের কী লীলা, দশ টাকায় বাজার!” ভাবতে ভাবতে পাশের ভগবান দাসের মাছের ব্যাগ তুলে নিয়েছিলাম। সে ব্যাগে কই, মাগুর, শিঙ্গি একেবারে গিজগিজ করছে। সেদিনের পর থেকে বাজার বদল করতে হল।

সেদিন বাড়িতে শ্বশুরবাড়ির লোক আসবে, স্ত্রীর হুকুম- একটা আস্ত মুরগি কেটেকুটে নিয়ে এসো। নিজের চোখে দাঁড়িয়ে দেখবে, অন্য কোন মাংস থেকে যেন মিশিয়ে না দেয়। আমার কিন্তু আস্ত মুরগি চাই।

তথাস্তু বলে বাজারে চললাম। ঠায় দাঁড়িয়ে মুরগি কাটা দেখলাম। বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই রান্নাঘর থেকে  চিল চিৎকার- এবারেও পারলে না? তোমার চোখে কি ন্যাবা হয়েছে? আমি হতবাক। নিজের চোখে মুরগির ছাল ছাড়ানো থেকে পিস করা পর্যন্ত সব দেখেছি- চোখের পলক পর্যন্ত ফেলিনি। তাহলে হলটা কি? স্ত্রী বেগুন পোড়া মুখ করে খেঁকিয়ে উঠলেন- সে-ই দুটো ঠ্যাং দিয়েছে! বাকি দুটো কোথায় গেল?

মনে বড় আঘাত পেলাম। মুরগিওলা এত নিষ্ঠুর! বারবার বললাম, পুরোটা দিবি, দুটো ঠ্যাং দিয়ে বাকি দুটো মেরে দিল? ছলছল চোখে বাজারে ছুটলাম। মনে মনে স্ত্রীকে স্মরণ করে মুরগিওলার কলার চেপে ধরলাম- বেইমান, মিরজাফর, মুরগির দুটো ঠ্যাং দিয়েছিস, বাকি দুটো কোথায়? হতচকিত দোকানী বলে উঠল- খুব যে রোয়াব নিচ্ছেন! সাপের পাঁচ পা দেখেছেন নাকি? সক্কাল সক্কাল চড়িয়ে এসেছেন?

আমিও ততোধিক বজ্রকঠিন গলায় বললাম- সাপের পাঁচ পা দেখেছিস তুই। আমাকে ঠকানো? আগে বল্‌  বাকি দুটো পা কোথায় গেল?

ঠিক সেই সময় কোঁকর কোঁ করে একটা মুরগি ডেকে উঠল। দোকানদার বলল- গুনে দেখুন মুরগির ক’টা  ঠ্যাং।

মুরগির চার পা দেখা, গরুর দু পা, ঘোড়ার এক পা কিংবা হাতিকেও সরীসৃপ হিসেবে মনে করা একটা রোগ, ডিল্যুশন। সাধারনত গভীর ডিপ্রেশন এবং তজ্জনিত এক ধরনের হতাশা থেকেই মানুষের দৃষ্টি বিভ্রম হয়, বুদ্ধি নাশ হয়, যুক্তি তক্ক মাথায় ওঠে। তাই হচ্ছে এখানে। পশ্চিমবঙ্গে এক ধরনের চতুষ্পদ মস্তিষ্কের দুর্বলতার কারণে সাপের পাঁচ পা না হোক, মুরগির চার পা দেখতে শুরু করেছে। একেই বলে দৃষ্টি বিভ্রম। আসলে গো চর্চা করতে করতে ওরা সবাইকেই চতুষ্পদ দেখছে। নেহাত ছেলেমানুষ! দিবাস্বপ্ন, স্বপ্নদোষ, ভগন্দর, অর্শ। চোখে অবনী ঘোষের টাইগার বাম লাগালে সব দোষ কেটে যাবে। মুরগি কা চারটো ঠ্যাং হো  সকতা হ্যায় বললেই তো আর মুরগির চারটে ঠ্যাং গজাবে না।  ভারতীয় জানোয়ার পার্টির লোকেরা মানুষকে চতুষ্পদ ভাবছে, সে খোয়াব দুদিন পরেই খানখান করে ভেঙ্গে যাবে। মিলিয়ে নেবেন স্যার, এই অধমের কথা অমৃত সমান।

Related Posts

Leave a Reply